
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিগত ১৩ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত পৌনে ১১টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মূলত ৬ মার্চ ইফতারি কেনার জন্য ঢাকা ক্লাবে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে যান তিনি। পরবর্তীতে তাঁকে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
ঢাবি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করে ১৯৮০ সালে ঐ বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন এবং ২০ জুন ২০২০ অবসরে যান। তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা শিক্ষক। শিক্ষক-সহকর্মী-শিক্ষার্থীদের কাছে ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। উল্লেখ্য, ২০০৯-১৭ পর্যন্ত ঢাবির ২৭তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সবসময় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও জনমানুষের কল্যাণে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বিভিন্ন পক্ষকে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন। নারী-উন্নয়ন, নারী শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমে নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে স্পেনের রাজা আরেফিন সিদ্দিককে ২০১১-১২ সালে ‘অর্ডার অব সিভিল মেরিট’ প্রদান করেন। আরেফিন স্যারের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল ধৈর্য সহকারে যে কারও কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, কিন্তু কথা বলতেন কম ও পরিমিত আকারে, যেটা না বললেই নয়।
এখন আরেফিন স্যারের সঙ্গে আমার কিছু স্মৃতিকথা উল্লেখ করতে চাই। ২০১৩ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিনের দায়িত্ব থেকে অবমুক্ত হয়ে বাংলাদেশ উন্মুুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার হিসেবে যোগদান করি। যোগদানের পর ঢাবি ভিসির বাংলোয় গিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করি এবং তিনি যথারীতি কিছু পরামর্শ দিয়ে কোনো সমস্যা হলে যোগাযোগ করার জন্য বলেন। সে থেকে স্যারের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ গড়ে ওঠে এবং পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে সবসময় খোঁজখবর নিতেন। সাউথ ইস্ট বিশ^বিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, জীবনবীমা করপোরেশন পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং ইউজিসির সাবেক সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে স্যারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করতেন। সর্বশেষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শের জন্য স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। বিগত ২৪ ফেব্রুয়ারি আমার মেয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে অনার্সসহ এমবিবিএস পাস করার সংবাদটি জানানোর জন্য স্যারের ধানমন্ডি বাসায় যাই। সাংবাদটি শুনে স্যার ভীষণ খুশি হন এবং আমার মেয়ে যেন ভালো ডাক্তার হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে পারে সেজন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেন।
সহজ-সরল-সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যন্ত অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক ছিলেন একজন বিনয়ী, সদালাপী ও সজ্জন মানুষ। অহংকার কিংবা দম্ভ কোনোকিছুই স্যারকে স্পর্শ করতে পারেনি। শিক্ষকতার পাশাপাশি দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যেমন নিজেকে সক্রিয় রেখেছিলেন, তেমনি রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে অর্পিত দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে গেছেন।
পত্রিকান্তরে জেনেছি, ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে তিনটি জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হলেও অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকের দীর্ঘদিনের কর্মস্থল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাবেক উপাচার্যের কোনো জানাজা অনুষ্ঠিত হয়নি। যদিও তার শিক্ষার্থী-সহকর্মীদের অনেকে চেয়েছিলেন ক্যাম্পাসে তাঁর অন্তত একটি জানাজা হোক। এমনকি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও স্যারের মরদেহ নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে, যা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন করেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রেওয়াজ অনুযায়ী ১৬ মার্চ একদিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে।
এটা সত্য যে, মৃত্যুর অমোঘ নিয়তি কেউ এড়াতে পারে না। জাগতিক নিয়ম মেনে বর্ণিল এ পৃথিবী থেকে একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে না ফেরার দেশে। অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক অত্যন্ত সৌভাগ্যবান এজন্য যে, তিনি পবিত্র রমজান মাসে জুমাবার রাতে মহান সৃষ্টিকর্তার ডাকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। বাদ জুমা নামাজে জানাজার পর ১৪ মার্চ শুক্রবার আজিমপুর কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয় তাঁকে। আমরা স্যারের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। একই সঙ্গে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া ও প্রার্থনা করছি, পরম করুণাময় যেন অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিককে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।
বর্তমানে যাঁরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়ে বাংলাদেশকে উদ্ভাসিত দেখতে চান, আমাদের বিশ্বাস অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক তাঁদের হৃদয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়