
দেশে অনিয়ম-অরাজকতা চলে আসছে নানা ক্ষেত্রে নানা উপায়ে। নদীদখল, নদীদূষণ তো মারাত্মক। এটি যে দেশের ওপর কী বিপুল নেতিবাচক প্রভাব রেখে চলেছে, সেটি অনুধাবনের শক্তিও যেন আমরা হারাতে বসেছি। পাহাড়খেকো বলে এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল পাহাড় ধস ও পরিবেশ বিপর্যয়ে ভূমিকা রেখে চলেছে। এর সঙ্গে ভূমিদস্যুরা তো রয়েছেই। ভূমি দখলের কালচারে ধানিজমিসহ বহু ফসলের জমিও কাটা পড়ে চলেছে। জমির অনুৎপাদনশীল ব্যবহার মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে বন-বনানীর জমি দখল-বেদখল কাণ্ডে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও পড়েছে হুমকির মুখে। নানা নেতিবাচক সংবাদের ভেতরে সরকারি সংস্থাকে বরাদ্দ বনের জমি বনে ফেরার সংবাদ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। শুক্রবার বন দিবসে সুসংবাদটি সামনে এসেছে। বনের ৮৭৫ একর জমির বরাদ্দ বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আরও ১৩ হাজার ৫৬৭ একরের বরাদ্দ শীঘ্রই বাতিল হচ্ছে। গত তিন দশকে সারাদেশে সরকারি ৪৫টি সংস্থাকে ১ লাখ ৬১ হাজার একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এসব জমির বড় অংশে এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে শুক্রবার সরকারি-বেসরকারিভাবে বিশ্ব বন দিবস পালিত হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্যÑ ‘বন-বনানী সংরক্ষণ, খাদ্যের জন্য প্রয়োজন’। বলা প্রয়োজন, দেশের ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি না থাকলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ খাদ্য জোগানও ব্যাহত হয়।
জাতীয় বননীতির ১৯ নম্বর ঘোষণায় বলা আছে, সরকারি মালিকানাধীন বনভূমি বনায়ন ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু এসব জমিতে নিত্যনতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পরিবেশবাদীদের আপত্তি উপেক্ষা করে মৌলভীবাজারের জুড়ীর লাঠিটিলা বনে ২০২৩ সালে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, মৌলভীবাজার (প্রথম পর্যায়)’ প্রকল্পে অনুমোদন দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এটি তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দুই মাস আগে চাপ দিয়ে ৩৬৪ কোটি টাকার প্রকল্পে অনুমোদন নেন তিনি। এতে সংরক্ষিত বনের ৫ হাজার ৬৩১ একর জমি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ছিল। তবে গত ডিসেম্বরে প্রকল্পটি বাতিল করেছে সরকার।
বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বন দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত বক্তব্যে বলেছেন, বনের জমি বরাদ্দের অর্থ এটিকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা। তবে বর্তমান সরকার সব প্রতিরোধ উপেক্ষা করে বন উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন সংস্থাকে দেওয়া বনভূমির বরাদ্দ বাতিল করা হচ্ছে। অবৈধ দখলদার যত প্রভাবশালীই হোক, ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টা, যেটুকু বনভূমি আমাদের হাতে আছে, তা যেন কোনোভাবেই না কমে। আসলে বনভূমি উন্নয়নকাজে দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। দিলে সরকার প্রধানের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু কোনো একক ব্যক্তির অনুমতির ওপর এটি নির্ভর করলে, রাজনৈতিক প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে কোথাও জমি না মিললে বনই ভরসা। ভাবখানা এমন, বনের জমি খালি খালি পড়ে আছে। কিন্তু একটি নগরী কিংবা একটা দেশে রাস্তা যেমন প্রয়োজন, নদী যেমন দরকার; বনও সমান প্রয়োজন।
স্বেচ্ছাচারীভাবে যেসব বন দখল করা হয়েছে, সেগুলো ফেরত আনার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখবে বলে আমরা বিশ^াস করতে চাই। সরকার ইতোমধ্যে প্রাকৃতিক বন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অন্যান্য প্রাকৃতিক বনে যেসব ধ্বংসাত্মক বা ক্ষতিকর কাজ হচ্ছে, সেগুলো কমিয়ে আনার পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। বন্যপ্রাণী, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার কাজে যাতে বন ব্যবহৃত হয়, সেগুলো নিশ্চিতের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলেই প্রত্যাশা।