ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১

হিলফুল ফুজুল: মহানবী (সাঃ) এর মহৎ উদ্যোগ ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ২২ মার্চ ২০২৫

হিলফুল ফুজুল: মহানবী (সাঃ) এর মহৎ উদ্যোগ ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ

 

 

সম্প্রতি দেশে রাজনৈকি পট পরিবর্তন হয়েছে। দীর্ঘ অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সর্বক্ষেত্রে অপরাধচক্র গড়ে উঠে। তাই আমরা বর্তমান সমাজে বিভিন্ন অপরাধের চিত্র দেখতে পাই । প্রতিনিয়ত বিরাজমান অপরাধের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হচ্ছে।  যা মানুষের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। সাধারণের প্রশ্ন, সমাজে অপরাধ কারা করে এবং কেন বাড়ছে ? সুশীল সমাজের উৎকন্ঠা, কিভাবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও সংহতি ফিরিয়ে আনা যায় ? সৃষ্টি জগতের শুরু হতে মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। অপরাধমুক্ত সমাজ সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। অপরাধ প্রবণতা মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। একটি রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিক সমান আদর্শে গড়ে তুলতে পারে না। যা রাষ্ট্রের পরোক্ষ ব্যর্থতা। সমাজের আদর্শচ্যুত ব্যক্তিগণই আপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধীগণ সঙ্গবদ্ধ হয়ে অপরাধ করছে। অস্থির করছে সমাজ ও সমাজব্যবস্থাকে। অবৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা,সম্পত্তির অবৈধ দখল, চাঁদাবাজি, জিম্মি করা, গুম করা, হত্যা করা, লুন্ঠন করা, পাচার করা, দুর্বৃত্তায়ন করা, অবৈধ ব্যবসা, নাশকতা, অগ্নি সংযোগ, মজুদদারী, সিন্ডিকেট কালচার, পতিতাবৃত্তিসহ বিবিধ অপরাধমূলক কাজ সমাজকে অস্থির করছে। এতে সামাজিক শৃঙ্খলা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বিঘ্নিত হচ্ছে।

 

মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এমন একটি সময় জন্মগ্রহণ করেন যখন আরব সমাজে চরম অরাজকতা বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল। গোত্রীয় কলহ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, সামাজিক শ্রেণিভেদ, নারী নির্যাতন , ব্যভিচার, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া প্রভৃতি সমাজকে মারাত্নকভাবে কুলষিত করেছিল। ঐতিহাসিকগণ এই সময়কে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বা ‘অন্ধকার যুগ’ বলে অবহিত করেন। বালক বয়সে হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরব সমাজে বিরাজমান অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতন বন্ধের উপায় খুঁজে বের করতে সর্বদা চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। অবশেষে মহানবী (সাঃ) এর মনে একটি অভিনব চিন্তার উদয় হয়। তিঁনি সমবয়সী কতিপয় যুবক নিয়ে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেন। তৎসময়ে এ সংগঠন সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো। মহানবী (সাঃ) ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তিঁনি শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেননি। বরং মহানবী (সাঃ) তৎকালীন আরব সমাজে বিরাজমান অন্যায়, অনাচার, অবিচার, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সফল অন্দোলনকারী হিসেবেও সাফল্য অর্জন করেন। মহানবী (সাঃ) এর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল ‘হিলফুল ফুজুল’ প্রতিষ্ঠা। মহানবী (সাঃ) এর নবুয়াত প্রাপ্তির ১৫ বছর পূর্বে অর্থাৎ ২৫ বছর বয়সে আরব সমাজের চলমান সহিংসতা নির্মূল এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ সামাজিক সংগঠনের উদ্ভব।

 

‘হিলফুল ফুজুল’ একটি সামাজিক সংঘ। এর শাব্দিক অর্থ হলো ‘শান্তি’ বা ‘কল্যাণের শপথ’। এটি জিলক্বদ মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পৃথিবীর প্রথম শান্তি সংঘ হিসেবে বিবেচিত । তদকালীন একটি বিশেষ যুদ্ধের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে মহানবী (সা.) এ সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন বলে মনে করা হয়। সম্ভবত ৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে ওকাজ মেলাকে কেন্দ্র করে পবিত্র জিলক্বদ মাসে কোরাইশ ও হাওয়াজিন গোত্রের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। মক্কার ওয়াকাজ নামক স্থারন ঘোড়দোঁড়, জুয়াখেলা ও কাব্য প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে গোত্রের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। আরব সমাজে জিলক্বদ মাস শান্তির মাস হিসেবে গণ্য। এ মাসে সকল ধরণের যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল এবং এ মাসে শুরু হওয়া যুদ্ধকে তখন ‘হরবুল ফুজ্জা ‘ বা ‘অন্যায় সমর’ বলা হয়। পাঁচ বছরের অধিক সময় এ যুদ্ধ স্থায়ী ছিল। যুদ্ধে বহু লোক প্রাণ হারায়। এতে মারাত্নকভাবে ব্যথিত হয় বালক মুহাম্মদ (সা.) কোমল হৃদয় । ‘হিলফুল ফুজুল’ প্রতিষ্ঠার নেপথ্য কিছু সামাজিক কারণও ছিল। যার মধ্যে অন্যতম ছিল আরবজুড়ে ব্যবসায়িক নিরাপত্তা বিধান। ঐ সময়ে দূরদূরান্তে ব্যবসা করার জন্য বিভিন্ন বাণিজ্য কাফেলা সফর করত। ব্যবসায়ী কাফেলা লুটপাট করার জন্য একশ্রেণির লুটেরা ওঁত পেতে থাকত। জুবাইদ গোত্রের এক ব্যবসায়ী একবার পণ্য নিয়ে মক্কায় আসেন। ব্যবসায়ী সরদার বিন ওয়াইল সাহমি তাঁর সব পণ্য কিনে নেন। আাস বিন ওয়াইল অনেক বড় ব্যবসায়ী হওয়ার দম্ভে ঐ ছোট ব্যবসায়ীর পাওনা পরিশোধ করলেন না। এ নিয়ে আরব সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আরবে শান্তি স্থাপনের জন্য মহানবী (সা.) ৫৯৫ থ্রিস্টাব্দে কিছু উৎসাহী যুবক ও পিতৃব্য জুবাইরকে নিয়ে এই শান্তিসংঘ গঠন করেন। এ সংঘের চারজন বিশিষ্ট সদস্য হলেন ফজল, ফাজেল, ফজায়েল ও মোফাজ্জেল। এ সংঘের কর্মসূচি ছিল : ১. দেশে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, ২. বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সদ্ভাব ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করা, ৩. অত্যচারিতকে অত্যাচীরর হাত হতে রক্ষা করা, ৪. দুর্বল ও অসহায় এতিমদের সহায়তা করা, ৫. বিদেশি বণিকদের জান ও মালের নিরাপত্তা বিধান করা ৬. সবধরণের অন্যায় ও অবিচার অবসানের চেষ্টা করা। মহানবী (সাঃ) প্রতিষ্ঠিত এ শান্তিসংঘ প্রায় ৫০ বছর স্থায়ী ছিল।

মানুষ অপরাধপ্রবণ জীব। মানুষ অনেক অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত। অপরাধের অন্যতম কারণ: দেশের দারিদ্র্যতা, বেকারত্ব, আইনের অপব্যবহার, ধর্মহীনতা, নৈতিক শিক্ষার ঘাটতি, মূল্যবোধজনিত সংশয়, হতাশা, ব্যর্থতাসহ বিবিধ কারণে মানুষ অপরাধ করছে। অপরাধ হচ্ছে সমাজস্থ মানুষের মধ্যকার দুষ্টুমনের বহিঃপ্রকাশ। যার সৃষ্টি হয় লোভের তাড়না হতে। অপরাধীগণ দেশে সুশাসনের ঘাটতি ও রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার সুযোগ খোঁজে। উপযুক্ত সুযোগে সমাজের উপর আঘাত হানে স্বীয় স্বার্থের জন্য। সমাজের সদস্যগণ যদি স্বার্থের কারেণে অন্ধ হয়, তবে সমাজ নিয়ন্ত্রণ হারায়। সমাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতি সকল নাগরিকের প্রত্যাশা। কিন্তু মানুষ জ্ঞাত ও অজ্ঞাত সারে অপরাধে জড়াচ্ছে। মানুষ ক্রমাগত ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক রীতি-নীতি, সামাজিক প্রথা ও রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্গন করে যাচ্ছেবর্তমান সমাজে যারা আদর্শচ্যুত, যারা মূল্যবোধগত সংকটে পতিত, যার রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যহীন তারাই সমাজে বিবিধ অপরাধের হোতা। প্রত্যেকে চায় অতি সহজে অর্থ উপার্জন, মুনাফা অর্জন, সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করতে। যার জন্য প্রয়োজন বৈধ পন্থা। কিন্তু সমাজের অপরাধীরা বৈধ পন্থায় লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে, অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। শুরু হয় অসৎ প্রতিযোগিতা। বাড়তে থাকে অনাচার, ব্যহত হয় সমাজিক নিয়ন্ত্রণ। বিংশ শতকে সভ্যতা চরম উৎকর্ষতার যুগেও সমাজে চরম অস্থিরতা বিরাজমান। সমাজ আজ নৈতিকতার চরম সংকট। বিশ্ব দেখছে স্বার্থান্ধতার নির্লজ্জ বহি:প্রকাশ। নাশকতা, সন্ত্রাস ও হিংসায় লিপ্ত সমাজে মানবতা আজ ভূলন্টিত।

রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সকল নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় সমাজের সকল পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। ‘সামাজিক নিয়ন্ত্রণ’হচ্ছে স্বেচ্ছাচারী আচরণ প্রদর্শন থেকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিরত রাখার প্রক্রিয়া। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হল সমাজের বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তা দূর করা। যার মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিদের বাঞ্চনীয় আচরণ প্রদর্শনে প্রভাবিত করা হয়। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কিছু মাধ্যম আছে । যথা: সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতি, মূল্যবোধ, দল, প্রতিষ্ঠান, পরিবার, ধর্ম, জনমত, আইন, শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি। বিশেষত সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। যার উজ্জল দৃষ্টান্ত মহানবী হযরত মুস্তফা (সা.) প্রতিষ্ঠিত সামাজিক সংগঠন ‘হিলফুণ ফুজুল’। যা মহানবী (সাঃ) আজ থেকে ১৪ শত বছর পূর্বে বিশ্ববাসীর জন্য সমাজ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিশ্ববাসীর নিকট দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে গেছেন।

 

বর্তমান বাংলাদেশে তারুণ্যের চেতনার উদ্ভব ঘটেছে। রাষ্ট্র সংস্কার, প্রগতি ও উন্নয়নে তারুণ্যের ভূমিকা অনন্য। প্রাচীন যুগ হতেই তরুণ সমাজে স্বেচ্ছামূলক মানসিকতার উন্মেষ ঘটে। যার অন্যতম উদাহারণ: হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর হিলফুল ফুজুল, গৌতম বৌদ্ধের সেবাশ্রম, বিবেকানন্দের রামকৃজ্ঞ মিশন ও গীর্জাকেন্দ্রিক সেবাকর্ম। এ উপমহাদেশে সমাজসেবায় শিশু, বালিকা ও তরুণীদের সম্পৃক্তকরণের জন্য ১৯০৮ খ্রি: লর্ড ব্যাটেন পাওয়েল স্কাউট আন্দোলনের সূচনা করেন। ১৯০৯ খ্রি: লেডি ব্যাটেন পাওয়েল গার্লস গাইড আন্দোলনের যাত্রা করেন। বর্তমান দেশে ‘নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণমূলক সংগঠন নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ অদ্যাদেশ-১৯৬১’ দ্বারা সামাজিক সংগঠনসমূহ পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে সমগ্রদেশে সমাজসেবা অধিদপ্তর নিবন্ধিত সামাজিক সংগঠন সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। দেশে অন্যান্য দপ্তরের আওতায় বিবিধ সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে। এ সংগঠনসমূহের প্রতিষ্ঠাতা দেশের জ্ঞাণী ও কল্যাণধর্মী ব্যক্তিগণ। দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সকল সামাজিক সংগঠনসমূহ স্বক্রিয় করতে হবে। সামাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় মহানবীর অন্যতম মহৎ উদ্যোগ ‘হিলফুল ফুজুল’ গঠন। যা আজও বিশ্ববাসীর নিকট এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

 

কানন

×