
যুদ্ধবিরতি ভেঙে গত সোমবার মধ্যরাত থেকে গাজার ঘুমন্ত মানুষের ওপর ব্যাপক হামলা শুরু করে ইসরাইল। প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়। গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় কার্যকর হওয়া প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি ১ মার্চ শেষ হয়েছে। এরপর জিম্মি মুক্তি দিতে রাজি করাতে হামাসের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে গাজায় মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে ইসরাইল। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে ওয়াশিংটনে বৈঠকের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার নিয়ন্ত্রণ নেবে। সেখানকার ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়ার বিষয়ে বলেছিলেন ট্রাম্প। এছাড়া এই অঞ্চলটিকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’ হিসেবে রূপান্তর করার পরিকল্পনা আছে বলেও ট্রাম্প জানান। গাজার বাসিন্দাদের জর্দান ও মিসরে স্থানান্তরের প্রস্তাব দেন তিনি। ট্রাম্প বলেন, গাজা পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব নিতে চায় তার প্রশাসন। অঞ্চলটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গোলাবারুদ সরিয়ে শহরটি ঢেলে সাজানোর বিষয়ে বলেন। তার প্রশাসন নতুন গাজায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও চাকরির ব্যবস্থা করবে বলেও উল্লেখ করেন। বর্তমানে গাজাকে মৃত্যু এবং ধ্বংসের প্রতীক উল্লেখ করে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরে যাওয়ারও তিনি আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, মিসর ও জর্দানের প্রশাসন গাজার শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানালেও, তিনি বিশ^াস করেন দুটি দেশই ফিলিস্তিনের বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দিয়ে উদারতার পরিচয় দেবে। তিনি আরও বলেন, গাজার জন্য প্রয়োজনে সব করা হবে। যদি সেখানে সেনা পাঠানোর প্রয়োজন হয় তাহলেও পাঠাবে। ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে ইসরাইল স্বাগত জানালেও মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। হামাস ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নির্বাসন এবং গাজা উপত্যকার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত ট্রাম্পের বিবৃতিকে হামাস প্রত্যাখ্যান করেছে। এমন বিবৃতি ফিলিস্তিন এবং এই অঞ্চল সম্পর্ক বিভ্রান্তি ও গভীর অজ্ঞতার প্রতিফলন। গাজা অবশ্যই সাধারণ কোনো ভূখণ্ড নয় এবং এটি এমন কোনো সম্পত্তি নয় যা কেনা-বেচা করা যায়। ট্রাম্পের এমন বিবৃতি প্রমাণ করে যে, ইসরাইলের প্রতি এবং ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে ও তাদের ন্যায্য অধিকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব অব্যাহত রয়েছে। একইসঙ্গে ট্রাম্পের এই বিবৃতি প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানায় হামাস। পরবর্তী সময়ে মিসর ও জর্দানসহ আরব বিশে^র নেতৃবৃন্দ গাজার বাসিন্দাদের না সরিয়েই বিকল্প একটি প্রস্তাব প্রদান করে। ট্রাম্পের ওই প্রস্তাবের বিকল্প হিসেবে আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে মিসরের একটি প্রস্তাবে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। মিসরের প্রস্তাবে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার পরিবর্তে গাজার পুনর্গঠনের কথা বলা হয়েছে। ট্রাম্পের প্রস্তাবের পরিবর্তে আরব নেতাদের পরিকল্পনায় গাজায় ৫ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের পুনর্গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ট্রাম্পের গাজা দখলের পরিকল্পনাকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা অবাস্তব বলে আখ্যা দিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা উপনিবেশবাদের নতুন রূপ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনার সমালোচনা করে রাশিয়া, চীন, জার্মানি বলেছে, এটি নতুন দুর্ভোগ ও নতুন ঘৃণা তৈরি করবে। ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে ফিলিস্তিনি জাতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য ইহুদিবাদী সরকারের পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা বলে ইরান উল্লেখ করেছে। গাজাকে খালি করে ফিলিস্তিনি জনগণকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার এমন পরিকল্পনা ফিলিস্তিনি জাতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্যই। ইরান এই পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন ছাড়াও তুরস্ক, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের বিরোধিতা করেছে। সৌদি আরব এই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। দেশটি জানায়, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঘোষণা ছাড়া ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে জড়াবে না। জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহ বলেছেন, তিনি ভূমি অধিগ্রহণ এবং ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার যে কোনো প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ভুল হিসাব কষছে। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যনীতির সমালোচনা করে তিনি বলেন, তাঁর গৃহীত মধ্যপ্রাচ্য নীতি সংঘাত বৃদ্ধি করবে। তিনি আরও বলেন, এমন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়; যা অঞ্চলের ইতিহাস, মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করে। ইসরাইলের গাজা আক্রমণকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরাইলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এরদোয়ান আহ্বান জানান। যদিও নেতানিয়াহু ট্রাম্পের প্রস্তাবটি অসাধারণ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে গাজা উপত্যকায় বসবাসকারী প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে স্থানান্তরিত করার ট্রাম্পের প্রস্তাবকে ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক ‘ফ্যান্টাসি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি এমন কোনো পরিকল্পনা বলে মনে হচ্ছে না যা কেউ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। এটি আরও বেশি উস্কানিমূলক বা ইসরাইলের প্রতি সমর্থন প্রদানের প্রচেষ্টা বলে মনে হচ্ছে। তিনি মনে করেন, ট্রাম্পের মন্তব্য আরব নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগের একটি চেষ্টা বা সতর্কতা হতে পারে; ‘যদি তোমরা সজাগ না হও, গাজার জন্য একটি বাস্তব সমাধান না দাও এবং হামাসকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে সাহায্য না করো, তাহলে তোমাদের জন্য এই পরিণতি অপেক্ষা করছে।’ তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে ফ্যান্টাসি হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে এই অঞ্চলের মধ্যপন্থি আরব রাষ্ট্রগুলো আরও ভালো পথ অবলম্বন করতে পারে; যা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবসম্মত হবে। নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলোচনায় ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথাও ট্রাম্প জানান। জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপনের কথাও বলেন ট্রাম্প। এমন পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে নেতানিয়াহু বলেন, হোয়াইট হাউসের মসনদে বসা শাসকদের মধ্যে ট্রাম্পই তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
গাজার বাসিন্দার যাতে স্বেচ্ছায় চলে যায় সেজন্য গত ৬ ফেব্রুয়ারি ইসরাইল সেনাবাহিনীকে একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কার্টজ। গাজার দখল নিয়ে ট্রাম্পের আকস্মিক ঘোষণার পর এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কার্টজ বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্টে ট্রাম্পের সাহসী পরিকল্পনার স্বাগত জানাই। গাজার বাসিন্দাদের চলে যাওয়ার এবং দেশত্যাগের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত; যেমনটি বিশ^জুড়ে করা হয়। ফিলিস্তিনিদের কারা গ্রহণ করবে এমন প্রশ্নের জবাবে কার্টজ বলেন, গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানের বিরোধিতাকারী দেশগুলোরই এটি করা উচিত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে এবং অন্যান্য দেশ, যারা গাজায় ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের জন্য তেল আবিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং মিথ্যা দাবি করেছে, তারা আইনত গাজার যে কোনো বাসিন্দাকে তাদের অঞ্চলে প্রবেশের অনুমতি দিতে বাধ্য। কার্টজের পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্থলপথে প্রস্থানের বিকল্প অন্তর্ভুক্ত থাকবে। পাশাপাশি সমুদ্র ও আকাশপথে প্রস্থানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও থাকবে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি নেতানিয়াহু এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সৌদি আরবের নিকট পর্যাপ্ত খালি জমি আছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ সৌদি আরবে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যেখানে তাদের অনেক ভূমি আছে। মিসর এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ইসরাইলের এই প্রস্তাবকে দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং অগ্রহণযোগ্য বলে অভিহিত করা হয়েছে। এটি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক পদক্ষেপ। এই প্রস্তাবগুলো সরাসরি সৌদি আরবের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। সৌদি আরবের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করে এমন বেপরোয়া মন্তব্য মিসর সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে বিবৃতি জানানো হয়। এছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গে পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরাইলের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোরও আহ্বান জানানো হয়। এদিকে গত ১২ মার্চ হোয়াইট হাউসে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাইকেল মার্টিনের সঙ্গে এক বৈঠকে ট্রাম্প গাজার বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, গাজা থেকে কাউকে বহিষ্কার করা হবে না। ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্ত স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হামাস। সংগঠনটির মুখপাত্র হাজেম কাসেম বলেন, ‘আমরা ইসরাইলি দখলদারিত্বকে যুদ্ধবিরতি চুক্তির সব শর্ত বাস্তবায়নে বাধ্য করার মাধ্যমে এই অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানাই’।
যুদ্ধপরবর্তী পরিকল্পনার আওতায় গাজার বাসিন্দাদের সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে পূর্ব আফ্রিকার ৩টি দেশ তথা সুদান, সোমালিয়া ও সোমালিল্যান্ডের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের কর্মকর্তারা যোগাযোগ করেছেন। যদিও সুদান এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে সোমালিয়া ও সোমালিল্যান্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, এমন প্রস্তাবের বিষয়ে তারা অবগত নন। এদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে হামাসের দেওয়া শর্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাখ্যান করেছে। হামাসের প্রস্তাব হচ্ছে যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়ন হলে মার্কিন-ইসরাইল নাগরিককে মুক্তি ও ৪ জিম্মির মরদেহ ফেরত দেবে। হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, আলোচনা পুনরায় শুরু করার জন্য মধ্যস্থতাকারীদের নিকট থেকে হামাস একটি প্রস্তাব পেয়েছে এবং তারা দায়িত্বশীল এবং ইতিবাচকভাবে এটি মোকাবিলা করছে। হামাস আরও জানায়, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়গুলোতে আলোচনা শুরু করার এবং একটি বিস্তৃত চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য সংগঠনটি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এছাড়া ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছানোর আহ্বান জানায় হামাস। মধ্যপ্রাচ্যে নিযুক্ত মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ হামাসের দেওয়া প্রস্তাবকে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যদিও কাতারের দোহায় যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা চলছে। ওই বৈঠকে উইটকফের নিকট গাজার জন্য মিসরের দেওয়া পুনর্গঠন পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে ৫ আরব রাষ্ট্র। উইটকফ গাজায় যুদ্ধবিরতির নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি ৫০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের ভিত্তিতে আলোচনায় ফিরতে প্রস্তুত বলে ইসরাইল জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব হচ্ছে, হামাসের নিকট থাকা ১১ জন জীবিত ও অর্ধেক মৃত ব্যক্তিকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হবে। ইসরাইলি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় বর্তমানে ২৪ জন জীবিত বন্দি এবং ৩৫ জন নিহত রয়েছেন। যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনার মধ্যেও গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা চলছে। হামলার পাশাপাশি গাজায় ত্রাণ সরবরাহ প্রবেশ করে দিয়েছে ইসরাইল। এর ফলে মানবিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, উপত্যকাটিতে ১২ লাখের বেশি শিশু মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। জরুরি চিকিৎসা সেবা না পাওয়ায় শিশুদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। আন্তর্জাতিক আহ্বানকে বরাবরের মতোই কোনো তোয়াক্কা না করে নিজের সিদ্ধান্তে নেতানিয়াহু অটল থাকায় চরম বিপাকে পড়েছে গাজার বাসিন্দারা। এদিকে নেতানিয়াহু ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দ সংস্থা প্রধানের ওপর আস্থা রাখতে না পারায় তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার পুনর্গঠন এবং ভবিষ্যৎ বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে। যদিও এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
গাজা দখলের পরিকল্পনার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ট্রাম্পের এমন পরিকল্পনা সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে। ট্রাম্পের এমন নীতি সৌদি আরবের জন্য ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদানের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। সৌদি আরব ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে, তা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিত। ট্রাম্প যদিও সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে ইচ্ছুক। ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলের সঙ্গে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। ট্রাম্প তখন আশা করেছিলেন সৌদি আরবও এই চুক্তির অংশ হবে। কিন্তু ট্রাম্পের গাজা খালি করার পরিকল্পনা তাঁর এমন আকাক্সক্ষা পূরণ হতে দেবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের এমন অবস্থানে আরব দেশগুলো মর্মাহত। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিরূপ মনোভাব তৈরি হবে। মিডল ইস্ট ইনস্টিিিটউটের মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিমালা বিষয়ক বিশ্লেষক ব্রায়ান কাটুলিস মনে করেন, সংশ্লিষ্টদের একটু ভড়কে দেওয়ার জন্যই ট্রাম্প এমন করেছেন। যেমনটা করেছেন কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর শুল্কারোপ এবং পানামা ও গ্রিনল্যান্ড দখল নিয়ে। তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয় না ট্রাম্পের আদতে কোনো পরিকল্পনা আছে। আর যদি থেকেও থাকে, তবে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, জনসাধারণকে জোরপূর্বক স্থানান্তরের প্রচেষ্টাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি আরব দেশগুলোও মনে করে, ট্রাম্পের এই প্রস্তাব জাতিগত নির্মূলে লক্ষ্যেই করা। জেনেভায় জাতিসংঘের মুখপাত্র মিশেল জ্যাকি বলেন, ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করে যে কোনো পরিকল্পনা বা যে কোনো ধরনের জাতিগত নির্মূলের দিকে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে থাকব। এটি আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মিসর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ, আরব লীগ বলেছে, এই ধরনের পদক্ষেপ এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। ট্রাম্পের এমন উদ্ভট পরিকল্পনা সংঘাত বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং জনসাধারণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ট্রাম্পের এমন প্রস্তাব ভবিষ্যতে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাকেও নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তাই এমন পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিন ও আরব রাষ্ট্রগুলোর উচিত হবে ট্রাম্পের গাজা খালি করার পরিকল্পনাকে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়