ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১

স্মৃতিতে অম্লান প্রিয় সম্পাদক

মোয়াজ্জেমুল হক

প্রকাশিত: ২০:০৫, ২১ মার্চ ২০২৫

স্মৃতিতে অম্লান প্রিয় সম্পাদক

আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

কাজের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের গভীরতা। এ সম্পর্ক গভীরতম হওয়ায় তিনি বিভিন্ন কারণে শুধু দিনে নয়, রাত-বিরাতেও ফোন করতেন চট্টগ্রামে আমাকে। দৈনিক জনকণ্ঠে যোগ দিই ১৯৯৩ সালের ১ অক্টোবর। পত্রিকাটির উপদেষ্টা সম্পাদক বর্ষীয়ান সাংবাদিক তোয়াব খানের প্রত্যক্ষ সুপারিশ এবং সম্পাদকের অনুমোদনে আমার যোগদান। শুরুতেই সিনিয়র রিপোর্টার পদে যোগ দিয়ে দশ বছর  পরবর্তী সময়ে স্পেশাল করেসপন্ডেট, আরও দশ বছর পর উপসম্পাদক এবং এর নয় বছর পর সর্বশেষ যুগ্ম সম্পাদক পদে পদোন্নতি পেয়ে জনকণ্ঠের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের সেই কর্ণধার আজ নেই। মহাসিন্ধুর ওপারে তিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী অসীম সাহসী সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ।
দেশের বিশিষ্ট শিল্প গ্রুপ গ্লোব-জনকণ্ঠ শিল্প (জিজেএসপি) পরিবারের প্রাণপুরুষ। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন এ শিল্প গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, তেমনি দেশের আধুনিক সংবাদপত্র দৈনিক জনকণ্ঠের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। আজ তাঁর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২১ সালের এই দিনে তিনি আকস্মিকভাবে সুন্দর এ পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছেন। পাড়ি জমিয়েছেন মর্ত্যলোক থেকে অনন্তলোক তথা স্বর্গলোকে। রেখে গেছেন তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়া জিজেএসপি ও স্বপ্নের দৈনিক জনকণ্ঠ। নীতির প্রশ্নে আমৃত্যু আপোসহীন আমাদের প্রিয় এই সাহসী সম্পাদকের বিদেহী রুহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন।
এই সাহসী সম্পাদকের কাছাকাছি যারা পৌঁছেছেন তারা সকলেই একবাক্যে বলবেন, জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি ভয়কে জয় করতে অটল অবস্থানে থেকে গেছেন। আগামীর নতুন স্বপ্নে সদা বিভোর থাকতেন। কঠিন বিপদেও তাঁকে ভেঙে পড়তে দেখা যায়নি কখনো। ব্যক্তি জীবনে চলাফেরায় স্টাইলিস্ট ছিলেন। ফলে তাঁর স্মার্টনেস ছিল সকলের নজরকাড়া। জনকণ্ঠসহ তার শিল্প গ্রুপের প্রতিটি ইউনিটের প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল নিবিড় বন্ধন। কর্মীদের ভালোবাসতেন আপন মনে। বিপদ-আপদের কথা জানতে পারলে সহযোগিতায় এগিয়ে যেতে সচেষ্ট হতেন। মারাত্মক কারণ ছাড়া কোনো কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা বা কঠিন শাস্তির আওতায় আনা তার ডিকশনারিতে ছিল না। কঠিন রাশভারি প্রকৃতির মানুষ হলেও তাঁর মাঝে হাস্যরসেরও কমতি ছিল না। অনেকটা একরোখা স্বভাব ও শক্ত মেজাজের হলেও কখনো কখনো তাঁর কথার মাঝে রসবোধও খুঁজে পাওয়া যেত। এসব নিয়ে এ শিল্প গ্রুপের কর্মীদের তিনি প্রিয়জন ও আস্থার প্রতীক ছিলেন। আজ তাঁর মৃত্যুদিবসে আমরা সকলে তাঁকে হারিয়ে খুঁজি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেওয়া ও নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আলাদা বৈশিষ্ট্যের। আড়ালে আবডালে নয়, যে কোনো অবস্থায় প্রকৃত সত্য বলতেই প্রত্যয়ী ছিলেনÑ এটাই ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যে কারণে তাঁকে চলার পথে কম বেগ পোহাতে হয়নি। তবুও কখনো অসত্যের সঙ্গে আপোস করেননি। সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়েই ছিলেন অবিচল। ১৯৯৩ সালে দৈনিক জনকণ্ঠের জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ২৮ বছর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। লোভ-লালসা, ভীতি, সরকারি-বেসরকারি, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক কোনো চাপে তাঁকে কখনো বিচ্যুত করা যায়নি। এটা ছিল সাহসিকতা ও নীতির প্রশ্নে তাঁর আপোসহীন চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য।
জনকণ্ঠ প্রকাশ হয়েছিল এক ভিন্ন আবহে। গতানুগতিক ধারাকে উপড়ে ফেলে আধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়ে দেশজুড়ে পাঠককে ভিন্ন ধরনের কিছু দিতে সচেষ্ট ছিলেন আমাদের এই প্রিয় সম্পাদক। যে কারণে অল্প সময়ের মধ্যে জনকণ্ঠ প্রচারসংখ্যায় শীর্ষে চলে যায়। ঢাকাসহ পাঁচ বিভাগীয় শহর থেকে একযোগে চার রঙা পত্রিকা প্রকাশনার ক্ষেত্রে দেশে জনকণ্ঠই প্রথম। সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ আগেই বুঝতে পেরেছিলেন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ছাড়া পত্রিকাকে পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই তিনি উপদেষ্টা সম্পাদক পদে যুক্ত করেছিলেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক তোয়াব খানসহ একঝাঁক মেধাবী সাংবাদিককে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মূল চেতনাকে ঊর্ধ্বে রাখার নীতিতে জনকণ্ঠ প্রকাশের শুরু থেকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। আবার গতানুগতিক স্রোতের বিপরীতে চলতে গিয়ে জনকণ্ঠ সম্পাদকসহ অনেক সংবাদকর্মীকে বহু কাঠখড়ও পোড়াতে হয়।
জনকণ্ঠ ছাড়াও তিনি তাঁর শিল্প গ্রুপের কর্মকাণ্ডেও থাকতেন সদা তৎপর। দিবারাত্রির অধিকাংশ সময় তিনি ইস্কাটনের অফিসেই কাটাতেন। বাসায় গিয়ে গভীর রাত অবধি নিজেকে কর্মে জড়িয়ে রাখতেন। জনকণ্ঠের প্রথম সংস্করণ ছাপা হওয়ার পরই তিনি সাধারণত ঘুমাতে যেতেন। এক কথায় তিনি ছিলেন কর্মযোগী তথা ওয়ার্কোহলিক (কাজপাগল)। তিনি এই শিল্প গ্রুপের ধ্রুবতারা। তিনি দ্যূতিময়, জ্যোতির্ময়। তার জীবনজুড়ে রয়েছে কঠোর সাধনা। যে কারণে স্বল্প পুঁজিতে প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবসা শুরু করে ধীরে ধীরে দেশের অন্যতম একটি শিল্প গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর কর্ণধার হয়েছেন।
সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে মানুষের জীবন। সংগ্রামের সাতকাহনে মোড়া ছিল আমাদের প্রিয় সম্পাদকের জীবন। তাঁর তেজী ও ব্যতিক্রমী মনোভাব, আকাশছোঁয়া মন, নির্লোভ, ন্যায়নিষ্ঠ, মানুষের জন্য কিছু করতে পারার চেষ্টা ছিল তাঁর চারিত্র্যিক ভূষণ। সফলতায় তার ছিল না কোনো অহংকার। আর ব্যর্থতায় থাকত না কোনো হতাশা। সফল ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি সিআইপির মর্যাদাও লাভ করেছিলেন। ঝুঁকি নিতেন, ঝাঁকি দিতেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি সফলতাকে আলিঙ্গন করে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। বেদনাবিদুর পরিবেশে আমরা তাকে বিদায় জানিয়েছি।
আতিকউল্লাহ খান মাসুদের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন ঢাকার গোপীবাগের মিশনারি স্কুলে। মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন আরমানিটোলা হাইস্কুলে। কলেজ জীবন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। এরপর তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। মূলত কলেজ জীবন থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি সাইড ব্যবসা শুরু করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশকে স্বাধীন করার পর তিনি ঢাকা থেকে করাচিতে কিছু পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন। এখান থেকেই তাঁর ব্যবসায়িক ও আর্থিক অগ্রগতি। এরপর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বস করপোরেশন নামে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। আর্থিক প্রসার ঘটায় তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। ১৯৭৮ সালে জাপানের কারিগরি সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন গ্লোব ইনসেক্টিসাইডস লিমিটেড, যা দেশের প্রথম মশার কয়েল প্রস্তুতকারী শিল্প কারখানা। এরপর একে একে প্রতিষ্ঠা করেন গ্লোব মেটাল কমপ্লেক্স, গ্লোব প্রিন্টার্স লিমিটেড, গ্লোব কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, গ্লোব সল্ট লিমিটেড, গ্লোব খামার প্রকল্প লিমিটেড, গ্লোব টেকনোলজিস্ট লিমিটেড ও গ্লোব টি লিমিটেড।
তাঁকে নিয়ে আমার বহু স্মৃতি। এসব স্মৃতি সদা স্মরিত হয় মনে। জাঁদরেল অথচ কোমল হৃদয়ের মানুষটি নীতি-আদর্শকে মনেপ্রাণে ধারণ করতেন। যাকে বিশ^াস করতেন তাতে কোনো খাদ থাকত না। অনেকের মতো অপত্যস্নেহে আমাকেও জড়িয়ে ছিলেন তিনি। ফলে জনকণ্ঠের নানা বিষয়ের পাশাপাশি তার শিল্প গ্রুপের বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য জানতে চাইতেন। উত্তরে যাই বলি অনেক ভেবেচিন্তে বলতে হতো। কারণ, আদ্যোপ্রান্ত জানতে চাইতেন। উত্তর দিতে হবে একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে। পছন্দ না হলে ‘দূর মিয়া’ বলে ধমক খেতে হতো। কথা বলতেন একেবারে মাপা মাপা। টেলিফোনে কথা শেষ হতেই আগেভাগেই বলে দিতেন ‘রাখো’। এটা তাঁর স্বভাবসিদ্ধই ছিল। প্রয়োজনে গভীর রাতেও ফোন দিতেন আমার মতো ক্ষুদ্র এক কর্মীকে। শুরুতেই বলতেন, ‘ওই মিয়া ঘুমাইছো’। না স্যার। তারপর প্রয়োজনীয় কথা বলে রাখো বলে টেলিফোন রাখতেন। যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে তিনি অফিসের সংশ্লিষ্ট অনেক সিনিয়রদের পরামর্শ জানতে চাইতেন। এটি ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আরেকটি দিক। সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে মামলার বিষয়টিকে তিনি পাত্তাই দিতেন না। উল্টো বলতেন, মন খুলে সত্য প্রকাশ করে যাও। মামলা-টামলা এগুলো আমি দেখব। তাকে নিয়ে মামলায় জড়িয়ে হাইকোর্ট থেকে জেলা পর্যায়ের আদালতে দাঁড়িয়েছি। সব সময় বলতেন, মামলাকে ভয় পেলে তো সাংবাদিকরা সত্য লিখবে না। তাই মন খুলে লিখতে হবে। ফলে সত্য প্রকাশের ব্রত নিয়েই জনকণ্ঠের জনপ্রিয়তা। এসব কথা শ্রদ্ধাভাজন সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদের। তাঁর সাহসে বলীয়ান থেকে জনকণ্ঠ সাংবাদিকদের ছিল পথচলা। এ প্রক্রিয়ায় প্রচারের শীর্ষে চলে গিয়েছিল জনকণ্ঠ। বিদেশেও জনকণ্ঠ প্রকাশের স্বপ্ন ছিল তাঁর। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় তা আর হয়ে ওঠেনি।
একবার চট্টগ্রামের প্রভাবশালী মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে একটি রিপোর্ট করেছিলাম জনকণ্ঠে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মহিউদ্দিন ভাই আমার বিরুদ্ধে একশ’ কোটি টাকার মানহানির মামলা করার প্রক্রিয়ায় লিগ্যাল নোটিস দেন। নোটিস পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদক স্যারকে বিষয়টি জানালাম। প্রথমে তিনি ঘটনা পরিষ্কার করে বুঝলেন। পরে বললেন, ওই নোটিস ছিঁড়ে ফেল। অনেকটা বিব্রত হলাম। কিছু বলার আগেই আবার বললেন, ছিঁড়েছো। জি স্যার, না স্যার বলতে গিয়ে তিনি ধমকের সুরে বললেন, নোটিসটি ছিঁড়ে বিনে ফেলে দাও। পরে যা হয় আমি দেখব। সাহস পেলাম। ছিঁড়ে ফেললাম। বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে মহিউদ্দিন ভাই আর এগোননি। মামলাও হয়নি। আরেকবার জনকণ্ঠে আমি একটি রিপোর্ট করেছিলাম। রিপোর্ট বের হওয়ার দিন সকালে তিনি ফোন দিলেন। বললেন, তোমার রিপোর্টের সত্যতা আছে তো? বললাম, ডকুমেন্ট আছে। ডকুমেন্টের বাইরে কোনো রিপোর্ট করিনি। উত্তরে বললেন, ঠিক আছে। রাখো বলে শেষ। পরে জেনেছি যে শিল্প গ্রুপের ব্যাপারে রিপোর্টটি করেছি সেটার মালিক তাঁর আত্মীয়। ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু না, তিনি আর কিছুই বলেননি। সত্য রিপোর্ট হওয়ায় তিনি উল্টো খুশি হয়েছেন। বিষয়টি আমাকে জানালেন উপদেষ্টা সম্পাদক।
এক-এগারো সরকারের আমলে সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ এবং দেশের বহু রাজনীতিক, শিল্পপতি গ্রেপ্তার হন। সঙ্গে চট্টগ্রামের মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীও। একসঙ্গে তারা জেল জীবনে ছিলেন দীর্ঘসময়। জেলে উভয়ের মধ্যে সখ্য হয়। জেলমুক্ত হওয়ার পর মহিউদ্দিন ভাই একদিন আমাকে ডাকলেন। বললেন, তোমাদের সম্পাদকের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা হয়েছে। অসীম সাহসী এই মানুষটিকে আমি সংবর্ধনা দেব। পরবর্তীতে দিন-তারিখ ঠিক করে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে তিনি আমাদের প্রিয় সম্পাদককে নাগরিক সংবর্ধনা দিয়ে সংবর্ধিত করেছিলেন। মিডিয়া জগতে বর্ষীয়ান সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর পর তিনি এই সংবর্ধনা লাভ করেন চট্টগ্রামে।
একেবারে কম বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন যেমন বলা যাবে না, তেমনি আবার বেশি হায়াত পেয়েছেন তাও নয়। সত্তর পেরিয়েই জীবনাবসান। পৃথিবীকে বিদায়। বেঁচে থাকলে তিনি আরও অনেক কিছু করে যেতে পারতেন। বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মিডিয়া জগৎকে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তাঁর সাহসে এই শিল্পগ্রুপ সদা বলীয়ান থেকে এগিয়েছে। সবকিছুতেই তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী। স্বভাবে খুব তেজী আমাদের প্রিয় সম্পাদকের শূন্যতা আমাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতি, যা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। প্রচারের জগতে থেকেও তিনি ছিলেন প্রচারভিমুখ। তাঁর জন্মদিনে সাংবাদিকদের আয়োজনে জনকণ্ঠ ভবনে কেক কাটা হতো অনাড়ম্বর পরিবেশে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে দু’বার আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। হাসিমুখে আমি তাকে কেক খাইয়েছিলাম। পাল্টা তিনিও আমার মুখে কেক তুলে দিয়েছিলেন। কি সৌভাগ্য আমার! শুধু আমি নই, অনেককে কেক খাইয়ে দিয়ে আনন্দ পেতেন। যতই রাশভারী প্রকৃতির হোন না কেন, জনকণ্ঠের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফ্যামিলি ডে-তে তিনি মন উজাড় করে দিতেন।
খেলাধুলার জগতেও ছিল তার বিচরণ। ক্রীড়া জগৎকে উন্নত করতে তাঁর ভূমিকা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল প্রশংসনীয়। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকায় ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে সহসভাপতি ও ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এর পাশাপাশি ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত গরিব ও অনাথ শিশুদের বিনা খরচে চিকিৎসা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
নিত্যদিনের কর্মের পরতে পরতে তাঁর জীবন ছিল বর্ণিল ও সুবাসিত। ব্যক্তিজীবনে কারও নিন্দা বা কাসুন্দি ঘাটতেন না। কাজের স্বপ্নে বিভোর থাকতেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ছিলেন তিনি। কখনো কারও জীবন, কারও দুর্বলতা, কারও আশা, কারও স্বপ্ন, কারও বিশ^াস, কারও সম্মান, কারও রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে কখনো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন না। যে কারণে জনকণ্ঠের শুরু থেকেই বহু মত ও পথের অনুসারী সাংবাদিকদের সন্নিবেশ ঘটে। তিনি মেধার সম্মান করতেন। মেধাবীদের যোগ্যতর অবস্থান করে দিতেন। এতে লাভবান হয়েছে জনকণ্ঠ। পাঠকের মন ছুঁয়ে হয়েছে সমৃদ্ধ। এরই ধারবাহিকতায় জনকণ্ঠ এগিয়েছে। তবে এক-এগারো সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘসময় জেলবন্দি করে রাখাতে তাঁর শিল্প গ্রুপের পাশাপাশি জনকণ্ঠের প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়েছে। ক্ষতি পুষিয়ে আনতে তাঁর কর্মতৎপরতা দ্বিগুণ বেড়ে যেতে দেখেছি। তবুও কারও প্রতি মুখাপেক্ষী হননি। এ প্রক্রিয়ায় একটি সত্য ঘটনা প্রকাশ করে উচ্চ আদালতে স্যুয়োমোটো মামলার শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু দমে যাননি। কোনো ধরনের ক্ষমা প্রার্থনা না করে আইনি লড়াই করে সাংবাদিকতার মান মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে রেখেছেন সিংহহৃদয় এ সম্পাদক। তাইতো তিনি নাক্ষত্রিক আলোকবর্তিকা। স্মরণের আবরণে অমর। তাঁর আদর্শ অনুসরণের প্রতীক। সাহসী সম্পাদক হিসেবে মর্যাদার সোপানে অবস্থান করে গেছেন। তাইতো তিনি পথিকৃৎ। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। রেখে গেছেন সুযোগ্য সহধর্মিণী শামীমা এ খানকে। যিনি এ শিল্প গ্রুপের হাল ধরেছেন। জনকণ্ঠের সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। তিনিও ভেঙে পড়ার নন। কঠিন যত পরিস্থিতি আসুক না কেন, তা মোকাবিলায় সচেষ্ট থাকছেন। মহান আল্লাহ তার প্রতি সহায় হোন। আমরা তার সাফল্য কামনা করি। আজ আমাদের প্রিয় সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদের প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। পরপারে ভালো থাকুন হে প্রিয় সম্পাদক।
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ

×