
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। নদীকে বাংলাদেশের প্রাণ বলা হয়। বাংলাদেশের উত্থান-পতন, শিল্প-সংস্কৃতি, বিকাশ সবকিছুই গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। আবহমানকাল থেকেই এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা নদীকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়েছে। নদীর গতিপথই এদেশের মানুষের জীবনে গতিসঞ্চার করেছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ তে ইরাকের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীকে কেন্দ্র করে যেমন পৃথিবীর প্রাচীনতম মেসোপটেমীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তেমনি গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ। নদী বিধৌত বাংলাদেশের বুক চিরে প্রায় ১০০৮টি নদী বয়ে গেছে। ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ কর্তৃপক্ষ’ (ইওডঞঅ)-এর মতে, ১৯৭১ সালে দেশে প্রায় ২৪,১০০ কিমি জায়গা জুড়ে নদ-নদীর অবস্থান ছিল। আর বর্তমানে তা ৬০০০ কিমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বিভিন্নভাবে নৌ যোগাযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। নদী এত প্রয়োজন হওয়া সত্ত্বেও আমরা নদীকে রক্ষা না করে নদীকে আরও দূষণ করে ধ্বংস করছি। বর্তমান সময়ে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডের কারণে নদী দূষিত হচ্ছে। নদী দূষণের একাধিক কারণ রয়েছে। যেমনÑ নদীতে শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্য নিক্ষেপ, অবৈধ শিল্পায়ন, জমিতে কীটনাশক ব্যবহার, জাহাজের পোড়া তেল-মবিল, পলিথিন বা প্লাস্টিকজাত দ্রব্য নিক্ষেপ ইত্যাদি। এছাড়াও নদীর তীরে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পকারখানা গড়ে তুলে নদীকে দূষিত করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার ফুসফুস খ্যাত বুড়িগঙ্গার তীরেই গড়ে উঠেছে ঢাকাশহর। কিন্তু বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের চরম পর্যায়ে অবস্থান করছে। ঢাকা শহরের দৈনন্দিন বর্জ্যরে প্রায় সবই নর্দমা, খাল বা ড্রেন হয়ে বুড়িগঙ্গায় পতিত হয়। এছাড়াও কলকারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল, জাহাজের পোড়া তেল-মবিল, পলিথিন-প্লাস্টিক ও অনিয়ন্ত্রিত মোটরচালিত নৌকা ইত্যাদি নদীটিকে দূষিত করে ফেলেছে। বুড়িগঙ্গার পানি এখন কুচকুচে কালো রং ধারণ করে চরমভাবে দূষিত হয়েছে। বর্তমানে বুড়িগঙ্গার স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এবং এই নদী তার অতীতের জৌলুস পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে।
বাংলাদেশে বুড়িগঙ্গার ন্যায় পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা প্রভৃতি নদীগুলোও দূষণের শিকার হচ্ছে। এসব নদী আজ মানুষের স্বার্থান্বেষী কর্মকাণ্ডের ফলে দূষণের শিকার হয়ে তাদের প্রবাহ ও গতিপথ হারিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীগুলো অস্তিত্বেও সংকটে ভুগছে। দেশের প্রায় অধিকাংশ নদী বিলুপ্তির পথে চালিত হচ্ছে। সম্প্রতি বিবিসির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে চারশত নদ-নদী হুমকির মুখে আছে। মানুষের ন্যায় নদীও গতিশীল, নদীরও জীবন আছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বাংলাদেশের তুরাগ নদীকে ‘জীবন্ত সত্ত্বা’ ঘোষণা করেছে। সুতরাং এই জীবন্ত সত্ত্বার ক্ষতিসাধন আইনত অপরাধ। আমাদের সকলকেই এই নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদীকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নদী দূষণ রোধে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্যপদার্থ নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন নদীতে চলমান অনিয়ন্ত্রিত মোটরচালিত নৌকাসমূহ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। নদীর তীরে অপরিকল্পিত বাসস্থান বা শিল্পকারখানা গড়ে তোলা যাবে না। নদী ভরাট বন্ধ না করে নদীকে তার গতিপথে চলতে দিতে হবে। সর্বোপরি সকল মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে সকলকে নদী রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং প্রয়োজনে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। তবেই আমরা নদীদূষণ বন্ধ করে দেশের নদীগুলোকে রক্ষা করতে পারব।
মো. তৌহিদুল ইসলাম তুহিন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা