ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১

গরমে পানি সংকট, দুর্ভোগে নগরবাসী

মোসা. মিশকাতুল ইসলাম মুমু

প্রকাশিত: ১৯:৩৭, ২১ মার্চ ২০২৫

গরমে পানি সংকট, দুর্ভোগে নগরবাসী

রাজধানীতে বসবাস করা মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। চৈত্রের গরমে অতিষ্ঠ নগরজীবন। প্রকৃতি পুড়ছে তাপপ্রবাহে। এলোমেলো হয়ে পড়েছে নগরজীবন। হাঁপিয়ে উঠেছে সব শ্রেণিপেশার মানুষ। অসহনীয় গরমে বিবর্ণ প্রাণ-প্রকৃতি। চলমান তাপপ্রবাহে মানুষের ভোগান্তি যখন চরমে তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পানির সংকট।

রাজধানী ঢাকায় প্রচÐ গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পানির সংকট। অনেক এলাকায় টানা কয়েকদিন ধরে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, আদাবর, ভাষানটেক, জুরাইন, নন্দীপাড়া, ত্রিমোহনী, ইব্রাহিমপুর, গুলশান, বাড্ডাসহ রাজধানীর অন্তত ১০-১২টি এলাকায় ঠিকমতো পানি পাচ্ছেন না বাসিন্দারা। কোথাও এক ঘণ্টা করে দিনে দুবার। আবার কোথাও সারাদিনে একবার, তাও ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত। ফলে পানির অভাবে নগরবাসীর দুর্ভোগ আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু এলাকায় তীব্র পানি সংকট আর সুপেয় পানির অভাবে একদিকে যেমন বাড়ছে রোগবালাই, সেইসঙ্গে বাড়ছে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পানি সংগ্রহের ভোগান্তি। ঠিক কীভাবে মিলবে এই সমস্যার সমাধান সেই প্রশ্নের নেই কোনো সহজ উত্তর।

এদিকে ঢাকা ওয়াসার দাবি, সার্বিকভাবে পানি সরবরাহে ঘাটতি নেই। প্রতিদিন প্রায় ২৯০ কোটি লিটার পানির উৎপাদনের সক্ষমতা আছে তাদের। গরমকাল এলে রাজধানীতে পানির চাহিদা থাকে ২৬০ কোটি লিটার। সে হিসাবে পানি সরবরাহে ঘাটতি থাকার কথা না। তবে এলাকাভিত্তিক কিছু জায়গায় সাময়িক সমস্যা রয়েছে। মূলত গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, অতিরিক্ত গরমে চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং প্রয়োজনের তুলনায় গভীর নলক কম থাকায় সমস্যা হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার একজন প্রকৌশলী জানিয়েছেন, গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় কিছু জায়গায় গভীর নলক থেকে পানি উত্তোলন কমেছে। গরমে পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং কয়েকটি এলাকায় চাহিদার তুলনায় গভীর নলক কম থাকায় সমস্যা হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার পানি শোধনাগার রয়েছে পাঁচটি। তবে সংস্থাটি পানি পাচ্ছে চারটি শোধনাগার থেকে। উপরিতলের পানির উৎপাদন ৭০ শতাংশে উন্নীত করার কথা থাকলেও সেই লক্ষ্য এখনো পূরণ করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা।

ঢাকায় পানির সংকট দিন দিন তীব্র হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তার মধ্যে অন্যতম হলো গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার। ঢাকার পানির প্রধান উৎস গর্ভস্থ পানি হলেও এটি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। অপরিকল্পিত মাত্রাতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। ফলে অনেক শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীর দূষণ পানির প্রবাহ হ্রাস বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ বালু নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হওয়ায় সরাসরি ব্যবহার করা সম্ভব নয়। পরিশোধন করা ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। যার ফলে পানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।অপর্যাপ্ত অবকাঠামো পানির সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার তুলনায় ঢাকা ওয়াসার পানির সরবরাহ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। নতুন নতুন আবাসিক বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে উঠলেও সেই অনুপাতে পানির ব্যবস্থা উন্নত করা সম্ভব হয়নি। ছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে স্বাভাবিক প্রবাহ কমে যাওয়া পানির অভাবের আরেকটি কারণ। গ্রীষ্মকালে বৃষ্টিপাত কমে যায় এবং নদীর পানির প্রবাহও হ্রাস পায়। যার ফলে পানির উৎস সংকুচিত হয়। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ ঢাকার পানির চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু পানি সরবরাহের সক্ষমতা সেই হারে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। সবশেষে, বিদ্যুৎ ঘাটতি পানির সরবরাহে অনিয়ম পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে পাম্প ঠিকমতো চালানো সম্ভব হয় না। যার ফলে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ ব্যাহত হয়।

ভয়াবহ পানি সংকট দুর্ভোগ পোহাচ্ছে নগরবাসী। বছরের অন্যান্য সময়ও পানির সংকট থাকে। কিন্তু রমজান মাসে পানি না থাকলে কেমন ভয়ংকর অবস্থা হতে পারে, তা আমরা এখন বুঝতে পারছি। পানি সংকটে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে অসুস্থ রোগী বয়স্ক ব্যক্তিরা। সংগ্রহ করা এই সামান্য পানি দিয়েই চলে গোসল, খাওয়া, রান্না-বান্নাসহ সব কাজ। এমনকি পানি খেতেও হয় হিসাব করে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, হেপাটাইটিসসহ নানা পানিবাহিত রোগ ছড়ায়। অপরিষ্কার পানি ব্যবহারের কারণে চর্মরোগ, চোখের সংক্রমণ অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে অনেকের। এছাড়া পানির অভাবে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। প্রায়ই পানির জন্য লাইন বা সংরক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে ঝগড়া, মারামারি বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। ধনী দরিদ্রের মধ্যে পানির বৈষম্য বাড়ে, যা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। পানি সংকটের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে, শিল্প বাণিজ্যিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, বিশেষ করে টেক্সটাইল, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ নির্মাণ শিল্পে পানির প্রয়োজন বেশি। পানির সংকটের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এদিকে পানি সংকট সমাধানে শহরের অলিগলিতে চলছে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি। কোথাও কোথাও সুয়ারেজ লাইন আর ওয়াসার পানির পাইপ মিলে মিশে একাকার। সেজন্যই ময়লা আর দুর্গন্ধযুক্ত পানির ভোগান্তি।

নগরবাসীর দুর্ভোগ কমাতে পানি সংকট সমাধান করতে হবে অনতিবিলম্বে। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পানি সংকট সমাধানের জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমেই গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। অধিক মাত্রায় নলক ব্যবহার না করে বিকল্প পানির উৎস (যেমন: নদী, জলাধার) ব্যবহার করতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা গর্ভস্থ স্তরে পুনঃসংযোজনের (জবপযধৎমব) ব্যবস্থা করতে হবে। ভবন শিল্প কারখানায় জধরহধিঃবৎ ঐধৎাবংঃরহম ঝুংঃবস চালু করা জরুরি। সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি টয়লেট ফ্লাশিং, বাগান পরিচর্যা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। নদীর পানি ব্যবহারের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। নদীর দূষণ রোধ করে পানি শোধনাগারের সংখ্যা কার্যকারিতা বাড়ানো দরকার। শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা অন্যান্য প্রধান নদীর পানি বিশুদ্ধ করে সরবরাহ বাড়াতে হবে। পানির অপচয় রোধ করতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম, স্কুল সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো দরকার। বাসা, অফিস শিল্পকারখানায় পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। এছাড়াও রয়েছে প্রযুক্তি অবকাঠামোগত উন্নয়ন। আধুনিক পাইপলাইন ব্যবস্থা স্থাপন করে পানির লিকেজ কমাতে হবে স্মার্ট মিটার ব্যবহার করে পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। পানির সুষম বণ্টন নীতিমালা প্রণয়ন, নি¤œবিত্ত বস্তি এলাকায় পানির সুবিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে। শিল্প কৃষিতে পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতিমালা শুল্ক প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ পানির সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, পানি উত্তোলনের জন্য সৌরবিদ্যুৎচালিত পাম্প ব্যবহার করা যেতে পারে।  যাতে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে পানি সংকট না হয়।

সর্বোপরি, গরমের সঙ্গে পানি সংকট নতুন কিছু নয়, তবে প্রতি বছর একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলছে। টেকসই সমাধান ছাড়া সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে সামনের দিনগুলোতে ভোগান্তি আরও বাড়বে। পানি সংকট মোকাবিলায় ব্যক্তিগত, সামাজিক সরকারী পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। পানি সংরক্ষণ সচেতনতার মাধ্যমে সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

×