ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২১ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১

সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে করণীয়

সুধীর বরণ মাঝি

প্রকাশিত: ১৯:৫২, ২০ মার্চ ২০২৫

সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে করণীয়

পত্রিকায় লেখালেখি হয়, টেলিভিশনে টকশো হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হয়, চোখের সামনে প্রিয় মানুষের মৃত্যু ঘটে, তবুও আমদের হুশ ফেরে না। মিথ্যা বলে যাচ্ছি অনর্গল, প্রতারণা করছি প্রতিযোগিতা করে, খাদ্যে ভেজাল  দিচ্ছি, লজ্জা-সম্মান ত্যাগ করে  নির্লজ্জতা ও বেহায়ার সর্বোচ্চ সীমানায়  পৌঁছে ঘুষ নিচ্ছি, পার্সেন্টেজ নিচ্ছি, দুর্নীতি করছি, লুটপাট করছি, সিন্ডিকেট করে মানুষকে খাঁচায় বন্দি করে ইচ্ছে মতো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করছি, বিদেশে টাকা পাচার করছি, ঋণখেলাপি হচ্ছি ইচ্ছে মতো। কোনো জবাবদিহি নেই, কাজের প্রতি দ্বায়বদ্ধতা নেই, কাজের স্বচ্ছতা নেই, আইনের শাসন  নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অলিখিতভাবে ঘুষ, দুর্নীতি, নিয়োগবাণিজ্য এবং পার্সেন্টেজ বাধ্যতামূলক করে ফেলেছে। তাই আইনের শাসন তেমন একটা চোখে পড়ে না। ঋণখেলাপি এবং টাকা পাচারের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে কালো টাকার পরিমাণ। সামাজিক বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। মানুষ তার ন্যায়বোধ হারিয়ে ফেলছে। স্বার্থপরতার চাদরে প্রতিনিয়তই নিজেকে ঢেকে ফেলছে। আমরা যেন এক অন্ধকার গলিতে আটকে পড়েছি। যেখানে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, মানবতা সব কিছু হারিয়ে গেছে । এই দুর্ব্যবহার এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে যদি আমরা একে অপরকে উৎসাহিত করি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কি একটি আদর্শ সমাজ রেখে যেতে পারব?
ঘুষ আর সেবা, পার্সেন্টেজ আর উন্নয়ন একসঙ্গে চলে না। রাষ্ট্র যাদের পেছনে সর্বোচ্চ ব্যয় করে, তারাই যখন পার্সেন্টেজের নেশায় আসক্ত, তখন সামনে থাকে শুধুই অন্ধকার। দেশে মাঝে মধ্যে ঘুষখোরদের শাস্তির কথা শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত কোনো পার্সেন্টেজখোরদের বিচার কিংবা শাস্তির কথা শুনিনি। আমরা ১০০ টাকার চোরকে কিংবা কোনো ছিনতাইকারী  গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করি কিংবা কখনো কখনো  গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলি। কিন্তু শত কোটি টাকা বা হাজার কোটি টাকার লুটপাটকারী, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক, ঋণখেলাপি কিংবা বিদেশে টাকা পাচারকারীদের স্যার বলে সম্বোধন ও সম্মান করি। এই হলো বর্তমান বাস্তবতা। সে অবস্থায় শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, ব্যবস্থারও পরিবর্তন চাই। তা না হলে যেই লাউ, সেই কদু। আমাদের ওপর শোষণ-নির্যাতন বাড়তেই থাকবে। স্বাধীনতা হলো জ্ঞানের বিশেষ অর্জন, নিয়ম-নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের সঠিক ধারণা। মালিক চায় শ্রমিক শোষণ, শ্রমিক চায় শোষণ থেকে মুক্তি। ব্যবসায়ী চায় সিন্ডিকেট, আমরা চাই সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার। ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে মুিক্ত আসবে না কোনোকালেই। আসুন বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তনে ঐক্যবদ্ধ হই আমরা।
যতদিন না আমরা ভালো মানুষ পাচ্ছি ততোদিন পর্যন্ত আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, গতিশীল অর্থনীতি, সামাজিক ও ধর্মীয়  সম্প্রীতি, সরকারি  সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে ঘুষ-দুর্নীতি-পার্সেন্টেজ বন্ধ করা, খেলাপি ঋণ উদ্ধার, বিদেশে টাকা পাচার রোধ কিংবা পাচারকৃত টাকা উদ্ধার কোনোটাই সম্ভব নয়। নিয়মিত সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় মূল্য বৃদ্ধি, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বৃদ্ধি, শিক্ষা উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, কালো টাকার মালিক হয়ে বিদেশে টাকা পাচার, মেধা পাচার, দেশের প্রতিটি অঞ্চলে মাদকের সয়লাব ঘটিয়ে, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।  
এভাবে চলতে থাকলে, একদিন আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে পৌঁছাব, যেখানে আর কিছুই বদলানোর শক্তি থাকবে না। বাঙালির নিজস্ব পরিচয় ও মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যাবে। কোনো আদর্শ বা নৈতিকতা আর  থাকবে না। যে সমাজের মানুষ একজন আরেক জনের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারে না, যেখানে প্রতারণা আর দুর্নীতি হয়ে ওঠে সাধারণ ব্যাপার, সেখানে মানবিকতা ধ্বংস হয়ে যাবে। নিজেদের অস্তিত্বের জন্য যদি কেউ দায়বদ্ধ না থাকে, তবে সামাজিক অস্থিরতা ও বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। সমাজের প্রতিটি স্তরে অবিচার এবং অনৈতিকতার কালো ছায়া পড়বে। একে অপরকে ঠকানো, দুর্নীতি, স্বার্থপরতাÑ এগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠবে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সমাজে অরাজকতা ও নৈরাজ্য বাড়ে, এবং মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ক্রমশ কমে যায়। সে অবস্থায় নিজেদের মানসিকতা এবং কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা পরিবর্তন করতে হবে। যদি এখনই সচেতন না হই, তবে একদিন এই পরিস্থিতি আমাদের সবাইকে গ্রাস করবে। এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তবে একসময় আমরা নিজেদের মর্যাদা ও পরিচয় হারিয়ে ফেলব। সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয়, আইন ও নীতির প্রতি অবহেলা বৃদ্ধি পাবে এবং শেষ পর্যন্ত এমন একটি পরিবেশে বসবাস করতে হবে যেখানে শুধু অবিচার, অশান্তি এবং অস্থিরতা বিরাজ করবে। যদি এখনই নিজেদের শুদ্ধতা ও দায়িত্ববোধের প্রতি সজাগ না হই, তবে একদিন হয়তো আমাদের সন্তানদেরও এই অন্ধকার সমাজে বড় হতে হবে। যেখানে তারা কেবল সংকটে পড়বে। এই চক্র যদি থামানো না যায়, তবে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। শুধু রাষ্ট্র নয়, ব্যক্তি জীবনেও অস্থিরতা, হতাশা, আর ভেঙে পড়া নৈতিকতা থেকে ফিরে আসার কোনো পথ থাকবে না।
এখন সময় এসেছে নিজে থেকে পরিবর্তন শুরু করার। কাজের স্বচ্ছতা, সর্বস্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার এবং  মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তরুণ এবং যুব সমাজের সামনে দেশ ও জাতির সঠিক ইতিহাস  তুলে ধরতে হবে।  প্রশাসনিক  সবার মাঝে একে অপরকে সম্মান, ন্যায় ও সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা ফিরিয়ে আনার। আমাদের একত্রিত হয়ে সঠিক পথে চলতে হবে। যদি প্রতিদিন সত্য এবং ন্যায়ের প্রতি একনিষ্ঠ থাকি, তাহলে হয়তো সমাজে কিছুটা হলেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। একমাত্র সচেতনতা, ঐক্য এবং সত্যের প্রতি আমাদের সম্মানই পারে  সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে। আমরা সবাই যদি একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি এবং দায়িত্বশীলতা বজায় রাখি, আইন এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে, নিজেদের দায়িত্ব পালন করি তবে ভবিষ্যতের জন্য একটি সৎ, সুশাসিত এবং ন্যায়বিচারের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারব। তাহলেই একদিন একটি সুন্দর এবং ন্যায়পূর্ণ সমাজ গড়ে উঠবে। বৈষম্যহীন সুন্দর কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। গড়ে উঠবে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষক

×