ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২১ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১

জীবন্ত সত্তা হিসেবে নদ-নদী ও বাঙালির জীবন

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ২০ মার্চ ২০২৫

জীবন্ত সত্তা হিসেবে নদ-নদী ও বাঙালির জীবন

শুষ্ক মৌসুম শুরু হয়েছে। পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের নদ-নদীর বেহাল অবস্থা নিয়ে নানারকম কথা প্রচার হচ্ছে। আমিও বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপপূর্বক একান্ত মনের টানে হাতে কাগজ-কলম তুলে নিয়েছিল। বিশে^র ছোট বড় মিলে ২৭টি সভ্যতার মধ্যে প্রায় সভ্যতাই গড়ে উঠেছে নদ-নদীকে ঘিরে। বস্তুত মানবসভ্যতা ও নদী পরস্পর সম্পর্কিত এবং অনেক ক্ষেত্রে পরিপূরক বললেও ভুল হবে না। নদীকে কেন্দ্র করেই মানবসভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। নদী বিভিন্ন আঙ্গিকে অফুরন্ত অবদান দিয়ে তার তীরবর্তী মানবসভ্যতার  উৎকর্ষ সাধন করেছে।  মূলত নদীর মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে মানুষ গড়ে তুলেছে শহর, বন্দর ও ব্যবসাকেন্দ্র। তাই নদীর প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণে সব দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু ধান-শালিকের এই বাংলাদেশে নদ-নদীর যে এত অবদান এবং প্রাণবৈচিত্র্য সমাহারের কেন্দ্রবিন্দু; সেই নদ-নদী আক্রান্ত এবং দিনে দিনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। বেশি দিন আগের কথা নয়। এক সময় বাংলাদেশ নদীমার্তৃক দেশ হিসেবে বিশ^ব্যাপী সুপরিচিতসহ ধন-ধান্যে পুষ্পেভরা ছিল। আজ সেই নদ-নদী চরম সংকটাপন্ন। দূষণ আর দখলে নদীগুলো হারাতে শুরু করেছে তার অস্তিত্ব। পাঁচ দশক আগেও হাজার নদীর (অর্থাৎ ১০০৮টি) তরুরাজি ঘেরা এই দেশের তকমা হারিয়ে এখন বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা কমতে কমতে ঠেকেছে মাত্র ৩১০টিতে। সংখ্যা ও নাব্য দুই-ই হ্রাসের কারণে এদের অবস্থানও সঙ্গিন। এমনকি, দেশের প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র রীতিমতো হুমকির মুখে। এমনই পরিস্থিতিতে নদ-নদীগুলোকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে আইনের হাত উঁচু করে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত। সঙ্গত কারণেই এই অভাবনীয় উদ্যোগকে হাজারো অভিনন্দন জানাই। নদ-নদীকে বাঁচাতে তথা রক্ষা করতে হাইকোর্ট ইতোমধ্যে নদ-নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, নদীর কি জীবন আছে এবং কিভাবে জীবন্ত সত্তা হতে পারে? এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, যার জীবন আছে, সেটাই ‘জীবন্ত সত্তা’। আর জীবন থাকার সুবাদে তার বেঁচে থাকার কতিপয় মৌলিক অধিকার স্বীকৃতিও লাভ করে। জীবন্ত সত্তার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো খবমধষ ঢ়বৎংড়হ বা খরারহম বহঃরঃু বা ঔঁৎরংঃরপ ঢ়বৎংড়হ। বিষয়টি যদি ঘুরিয়ে বলি, তাহলে দাঁড়ায় যেসব ব্যক্তি বা বস্তুর আইনি স্বীকৃতিসহ কতিপয় অধিকার ও সুবিধা নির্দিষ্ট করা থাকে, তাকে বলা হয় ‘জীবন্ত সত্তা’। এক্ষেত্রে খ্যাতনামা ঈড়ৎহবষষ খধি ঝপযড়ড়ষ-এর সংজ্ঞানুযায়ীÑ ‘জীবন্ত সত্তা হলো সেই ব্যক্তি বা বস্তু, যাকে ব্যক্তি হিসেবে কতিপয় অধিকার প্রদান করা হয়’। উক্ত আইনে বর্ণিত সুবিধা কিংবা অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে ঐ ব্যক্তি বা বস্তু আদালতে তার প্রতিকার চাইতে পারেন। সেহেতু মানুষ বা অন্যান্য প্রাণির মতো, নদীও তার বেঁচে থাকার জন্য আদালত কর্তৃক কতিপয় মৌলিক অধিকার লাভ করে। এক্ষেত্রে বস্তুগত কোনো সম্পত্তিকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হলে; সেক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি ঐ বস্তুর পক্ষে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন। আর আদালত সেই ব্যক্তি বা বস্তুর বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেবেন। এ বিষয়ে সহজে বলতে পারি যে, আদালত কর্তৃক কতিপয় মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানই হলো জীবন্ত সত্তার প্রতিভূ। এক্ষেত্রে সেই বস্তু তথা নদী মনুষ্যজীবের মতো অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকতে পারে।
সঙ্গতকারণেই নদ-নদীর জীবন্ত সত্তার বিষয়ে ইতিহাস থেকে সংগৃহীত তথ্যাদির আলোকে কিছুটা আলোচনা করা যেতে পারে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে সর্বপ্রথম কলম্বিয়ার সাংবিধানিক আদালত চকো রাজ্যের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে আত্রাতো (অঃৎধঃড়) নদীকে ‘স্বাধীন সত্তা’ (অঁঃড়সড়সড়ঁং বহঃরঃু) হিসেবে ঘোষণা করেন। এদিকে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হাইকোর্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনার জন্য পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত গঙ্গা নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেন। বস্তুত হিন্দু সম্প্রদায় এ নদীকে ‘গঙ্গা মাতা বলে অভিহিত করে থাকেন। তবে পরবর্তীতে আদালতের এ ঘোষণা বাতিল হয়ে যায়। আর ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তুরাগ নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। এ বিষয়ে ২৮৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালের ১ জুলাই। ঐতিহাসিক এ রায়ে তুরাগসহ বাংলাদেশের মধ্যে ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবহমান সকল নদ-নদীকে আইনি ব্যক্তি (খবমধষ ঢ়বৎংড়হ) বা আইনি সত্তা (খবমধষ বহঃরঃু) বা জীবন্ত সত্তা (খরারহম বহঃরঃু) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে দেশের সকল নদ-নদীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করে সুরক্ষা, সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের নিমিত্ত নদী রক্ষা কমিশনকে আইনানুগ অভিভাবক ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে, আইনসভায় আইন পাশের মাধ্যমে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণাকারী বিশ্বের প্রথম দেশ হলো নিউজিল্যান্ড। ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের আইনসভায় ‘হোয়াংগানুই’ (ডযধহমধহঁর) নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করা হয়। আসলে দূষণ ও দখলের হাত থেকে রক্ষা করতেই নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়। কোনো নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হলে, সে নদী মানুষ ও প্রাণীর ন্যায় কতিপয় আইনি অধিকার লাভ করে। এর মাধ্যমে মানুষের মতো নদীরও কতিপয় মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় এবং যুগপৎ তা রক্ষার আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
অসংখ্য নদ-নদী বাংলাদেশকে জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে। শুধু তাই নয়, নদীর কলতান ও সৌন্দর্য বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় রূপময় অবয়ব দান করেছে। বাংলাদেশের নদ-নদীর অনেক বিশেষত্ব ও বৈচিত্র্য রয়েছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, দেশে ২০০ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি দৈর্ঘ্যরে নদী আছে ১৪টি। যেমনÑ পদ্মা, ইছামতি, সাঙ্গু/শঙ্খ, ধলেশ^রী, কুশিয়ারা, সুরমা, ভৈরব, বংশাই, কপোতাক্ষ, পুরাতন ব্রক্ষ্মপুত্র, পূর্ণভবা, মেঘনা, বাঙ্গালী ও নবগঙ্গা। সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম নদী হলো ৩টি। যেমনÑ গাঙ্গিনা, কলমদানী ও ইটবাড়িয়া। মজার বিষয় হলো যে, ১১টি নদী আছে শুধু ইছামতি নামেই। আর বাংলাদেশে নদীপথ হলো ২২০০০ কিলোমিটার। সবচেয়ে বেশি নদী প্রবাহিত জেলা সুনামগঞ্জ (৯৭টি নদী) আর সবচেয়ে বেশি জেলা দিয়ে প্রবাহিত নদী পদ্মা (১২টি জেলা)। এ রকম মজার মজার নানা তথ্য আছে। কিন্তু নিবন্ধের কলেবরের স্বার্থে তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এসব নদ-নদীর অপার সৌন্দর্য ‘বাংলাদেশীদের’ মুগ্ধ করে। এ সকল নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতি।
বাংলাদেশের নদ-নদীর সৃষ্টি ও বিস্তার নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি, ধর্মীয় পুরাণ ও লোকগাথা। বাংলাদেশের বড় বড় নদ-নদীর তর্জন-গর্জন ও প্রমত্ততা নিয়েও আছে নানা ইতিহাস। নদীকে উপজীব্য করে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। রচিত হয়েছে অসংখ্য উপন্যাস, নাটক, কবিতা, গান ও লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা। তাই নদ-নদী বাঙালি জাতির স্বকীয়তার ধারক ও বাহক বললে বেশি বলা হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু ক্রমাগত দখল ও দূষণে বাংলাদেশের অনেক নদী বর্তমানে মৃতপ্রায়। শিল্প-কারখানার বর্জ্য, বিষাক্ত কেমিক্যাল, ক্ষতিকর প্লাস্টিক, পলিথিন, জৈব, অজৈব ও গৃহস্থালী বর্জ্য নিক্ষেপ করে নদীকে দূষিত করা হচ্ছে। ফলে, নদীগুলো এখন সেই নদীর রূপে নেই। শুধু তাই নয়, এসব নদীর তীরবর্তী অঞ্চল এখন চাষাবাদের প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অধিকন্তু এতদঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে নানা রকম রোগব্যাধি। অতীব দুঃখের বিষয় হলো যে, তথাকথিত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা নদী দখল এখন বাংলাদেশে এক ধরনের অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা এতটাই ক্ষমতাধর যে, আইন ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নদী দখল করে যাচ্ছে নদীখেকো দুর্বৃত্তরা।
বর্তমানে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো হুমকির সম্মুখীন এবং বলতে গেলে অস্তিত্ববিলীন হওয়ার পথে। সত্যি কথা বলতে কি, সেই শহর বা জনপদ সবচেয়ে সৌভাগ্যবান, যে শহর বা জনপদের পাশ কিংবা মধ্য দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়। আর আমাদের দেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে একটি নয়, দুটি নয়, চার চারটি নদী প্রবহমান। ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর যথাযথ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে ঢাকা বহু আগেই হংকং কিম্বা সিঙ্গাপুরের চেয়েও সুন্দর এবং নান্দনিক মহানগরীতে পরিণত হতো। অথচ আমরা আমাদের সৌভাগ্যকে পায়ে দলিতপূর্বক দুর্ভাগ্যে পরিণত করেছি ক্রমাগতভাবে নদী দখল এবং দূষণের মাধ্যমে। যেভাবেই বলি না কেন, নদীসমূহ বাঁচা-মরার ওপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভর করে। মূলত নদী আমাদের বেঁচে থাকার ভরসা। নদ-নদী আমাদের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা এবং নান্দনিকতার জন্য বড় নিয়ামক। কিন্তু এভাবে নদ-নদী দূষণ ও দখল হলে তা একদিন বিলীন হয়ে যাবে। আর নদ-নদী বিলীন হয়ে গেলে থাকবে না পানি। পানি না থাকলে থাকবে না মৎস্য সম্পদ। হবে না কৃষিকাজ এবং মানুষের পক্ষেও বেঁচে থাকা দুরূহ হয়ে উঠবে। সহজ ভাষায় যদি বলি তাহলে এই দাঁড়ায় যে, পানি না থাকলে থাকবে না জীবন। অর্থাৎ ব্যক্তি হিসেবে বেঁচে থাকার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার হারিয়ে যাবে বাঙালি জাতির। তাই নদী রক্ষার দায়িত্ব যেমন রয়েছে রাষ্ট্রের, তেমনি সচেতন হতে হবে জনগণকে। নদী রক্ষার দায়িত্ব কেবল কোনো বিশেষ সংস্থা বা গোষ্ঠীর নয়। এটা আমাদের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য জাতীয় আন্দোলন। আন্দোলনে আমাদের সবাইকে আন্তরিকতা নিয়ে শরিক হতে হবে।

লেখক : গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
[email protected]/www.goonijon.com

×