ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২১ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

ইতিকাফ

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ১৯:৪৭, ২০ মার্চ ২০২৫

ইতিকাফ

ইতিকাফ হচ্ছে পবিত্র রমজান মাসের সামগ্রিক কল্যাণ ও বরকত লাভের ইবাদত। রমজানের প্রথম অংশে কোন কারণে যদি পূর্ণ প্রশান্তি, স্থির চিত্ততা, চিন্তা ও হৃদয়ের একাগ্রতা এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন ও তার রহমতের দরজায় পড়ে থাকার সৌভাগ্য অর্জিত না হয়, সে অপূরণীয় ক্ষতি ও আফসোস পুষিয়ে দিতে করুণাময়ের পক্ষ থেকে উত্তম ব্যবস্থা হলো ইতিকাফ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) খালিস নিয়তে ইতিকাফ পালনের সাওয়াবকে এক হাদিসে হজ ও ওমরার পুণ্যের সঙ্গ তুলনা করেছেন। হযরত আয়েশা (রা.) রিওয়ায়েত করেছেনÑ ‘ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত নবী কারীম (স.) রমজানের শেষ দশদিন বরাবর ইতিকাফ পালন করেছেন এবং তার ইন্তিকালের পর তার স্ত্রীগণ ইতিকাফের এ পুণ্যধারা অব্যাহত রেখেছেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)। এরপর থেকে উম্মাহর দ্বীনদার মানুষগণ ব্যাপকভাবে তা পালন করে আসছে। ছোটকালে আমরাও মহল্লার মসজিদগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ময়-মুরব্বিকে ইতিকাফ গ্রহণ করতে দেখতাম। কিন্তু এ স্বল্পকালের ব্যবধানে বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে মানুষের মন মানসিকতার মাঝে। এখন মসজিদে মসজিদে একজন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মুতাফিক বা ইতিকাফ করণেওয়ালা লোক পাওয়াও মুশকিল। এটি রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়। আজকের ধর্মপ্রাণ মুরব্বি শ্রেণির উচিত, আমাদের মহান পূর্বসূরিদের ঐতিহ্যময় সাধনার পথে নিজেদের আবগাহন করা, নিজেদের সম্পৃক্ত করা এ ধারাবাহিক সুন্নাতে নববী, সুন্নাতে আসহাব ও সুন্নাতে সালফেসালেহীনের সঙ্গে।
আসলে ঐতিহ্যজ্ঞান ও ঐতিহ্য সচেতনতা বড় কথা। আজকে আমাদের সমাজে খোদাভীতিও আছে, ধর্ম কর্ম পালনের মানসিকতাও আছে। নেই শুধু ইমান ও আমলের শাখাগুলো চেনার পর্যাপ্ত জ্ঞান। দেশ ও জাতির আলেম ওলামাদের উচিত, নিজেরা পালন করে এবং অন্যদের উৎসাহিত করে সমাজে আবার ইতিকাফের মর্যাদা ও আগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। কুপ্রবৃত্তি দমন ও চরিত্র সুনিয়ন্ত্রিতকরণের জন্য ইতিকাফ একটি বলিষ্ট ওয়াসিলা। কারণ মসজিদ এমন এক শান্ত শীতল পুতঃস্নিগ্ধ জায়গা যেখানে মানুষ কখনো কুচিন্তা মাথায় রাখতে চায় না। মসজিদে থাকা ও শোয়া অনেক ওলামায়ে কেরাম জায়েজ মনে করেন না। কিন্তু শরিয়ত শুধু ইতিকাফের সময় তা উদারভাবে অনুমোদনপূর্বক উৎসাহিত করে। সুতরাং এ সুযোগ কাজে লাগানো দরকার। এখানে আসলেই তো আপনার মাঝে নির্জন বাস, কবর জীবনের কথা, নীরব নিস্তব্ধ এক আখেরি মঞ্জিলের কথা ভাবার ফুরসত হয়। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম লিখেছেনÑ ইতিকাফের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে গায়রুল্লাহর মোহনীয় বেড়াজাল থেকে মুক্তি লাভ করে আল্লাহর সাথে পরিপূর্ণ ও গভীর প্রেমময় সম্পর্ক স্থাপন। রমজানের পবিত্র মাসে নির্জন বাস ও ইতিকাফের মাধ্যমে হৃদয় ও আত্মার এমন অভাবনীয় উৎকর্ষ সাধিত হয় যে, মানুষের হৃদয়ে তখন আল্লাহর যিকির ও তার প্রতি গভীর প্রেম ছাড়া অন্যকিছু স্থান পায়না। .......(যাদুল মায়াদ: পৃ: ১৮৭)।
হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা নামক বিখ্যাত দর্শন গ্রন্থে আল্লামা শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ (র.) লিখেছেনÑ ‘মসজিদের ইতিকাফ হচ্ছে আত্মিক প্রশান্তি, হৃদয়ের পবিত্রতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, ফেরেশতাকূলের গুণাবলি অর্জন এবং শবে কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সকল প্রকার ইবাদতের অখণ্ড সুযোগ লাভের এক সর্বোত্তম উপায়। তাই আল্লাহর রাসুল (স.) রমজানুল মুবারকের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করেছেন এবং উম্মতের সৎ ও ভাগ্যবান লোকদের জন্য তা সুন্নতরূপে ঘোষণা করেছেন।’ Ñ(২/৪২)। যারা স্বেচ্ছায় কিংবা সামাজিক অর্পিত দায়িত্ব নিয়ে ইতিকাফ করেন তারা গোটা সমাজের, গোটা মহল্লার মেহমান। তাদের প্রতি কোন কার্পণ্য নয়, অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সকলের সহানুভূতি পরায়ন হওয়া উচিত।
পরিশেষে আমরা বলব ইতিকাফ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া। অর্থাৎ এটি নিয়মিত সামাজিক সুন্নাত। মহল্লার কেউ কেউ পালন করলে সবাই অন্তত এর সওয়াবের ভাগি হয় এবং দায় থেকে মুক্তি পায়। আর যদি মহল্লার কারো পক্ষ থেকে তা পালিত না হয় তাহলে গোটা মহল্লাবাসী এর জন্য দায়ী ও গুনাহগার হয়ে থাকে। এ জন্য কাউকে বলে কয়ে হলেও তা আদায়ের ব্যবস্থা নিন। আসুন উদ্ধার করি হারিয়ে যাওয়া রমজানের মূল্যবান কালচার, পরকালমুখী আত্মগঠনের এক বলিষ্ঠ মাধ্যম এবং মসজিদ আবাদ রাখার এক দায়িত্বপূর্ণ সামাজিক কার্যক্রম পবিত্র ইতিকাফ সাধনা। তথাকথিত আধুনিকতা ও নানা কর্মব্যস্ততার ব্যাপকতায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অনেক ধর্মীয় মূল্যবোধ। এর খেসারতও আমাদের কম দিতে হচ্ছেনা। সর্বস্তরে নীতিনৈতিকতা ও ঐকান্তিকতা বিলুপ্ত হয়ে সেখানে গজিয়ে উঠছে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা সামাজিক অস্থিরতা ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন প্রণালী। খোদ মুসলিম ব্যবসায়ীরা ফরমালিন ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে ইফতার ও সাহরির সামগ্রী ধ্বংস করেছে, সৃষ্টি করেছে সিয়াম সাধকদের জীবনে অশান্তি, অসুস্থতা ও দুশ্চিন্তা। ঈদুল ফিতরের ইবাদত, আধ্যাত্মিকতা ও পবিত্রতার স্থলে চেপে বসেছে নানা অপচয় অপব্যয় ও লোক দেখানো অপসংস্কৃতির। ২০ রাকাত তারাবির ঐতিহ্যের মধ্যে কুঠারাঘাত করে কতিপয় লোক যুদ্ধে নেমে পড়েছে ৮ রাকাতে নিয়ে আসার জন্য। এখন মসজিদে মসজিদে তারাবির জামাতের মাঝখানে এ ধরনের কিছু লোকের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। অর্থাৎ এক শ্রেণির লোকের প্রচণ্ড মাথাব্যথায় পরিণত হয়েছে ইসলামের দৈনন্দিন মূল স্রোতধারার মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। এভাবেই আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে রমজানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য ও শেষ ১০ দিনের মসজিদে আল্লাহকে ডাকার মজনু ইতিকাফকারীদের স্বল্পতা। এক্ষেত্রে মসজিদ কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দ ও দরদি আলেম ওলামাদের এগিয়ে আসা জরুরি।

ইতিকাফের শর্তাবলি
১. নিয়ত করা; নিয়ত না করলে ইতিকাফ সহিহ হবে না।
২. পুরুষের জন্য এরকম মসজিদ হতে হবে, যেখানে জামাতের সঙ্গে সালাত আদায় করা হয়। (তবে নফল ইবাদত যে কোনো মসজিদে হতে পারে।) মহিলারা নিজেদের ঘরে সালাত অদায়ের স্থানে ইতিকাফ করবেন তারা প্রয়োজন ব্যতীত ওই স্থান থেকে বের হবে না।
৩. রোজা রাখা। তবে নফল ইবাদাতের জন্য রোজা রাখা শর্ত নয়।
৪. মুসলমান হওয়া। কেননা কোন অমুসলিম ব্যক্তি মুসলমান হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
৫. আকিল-জ্ঞানবান হওয়া। প্রাপ্তবয়স্ক বা বালিক হওয়া। ইতিকাফে সহিহ হওয়ার জন্য শর্ত নয়। এজন্য জ্ঞানবান, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক, বালিকার ইতিকাফ সহিহ হয়, যেমনিভাবে তাদের নামাজ রোজা দুরস্ত হয়।
৬. নারী-পুরুষ সকলে জানাবাত গোসল ফরজ হয় এমন অপবিত্রতা থেকে এবং নারীদের হায়িজ নেফাজ থেকে পবিত্র হওয়া। (আলমগীরি ১ম খণ্ড ও বাদায়েউস সানায়ে, ২য় খণ্ড)।

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]

×