ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২০ মার্চ ২০২৫, ৫ চৈত্র ১৪৩১

আইনের শাসন জরুরি

সাজ্জাদ হোসেন রিজু

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ১৯ মার্চ ২০২৫

আইনের শাসন জরুরি

আমার তিন কন্যা। ওরা বেড়ে উঠছে একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে। ঢাকা শহরের ফ্ল্যাট বাসার কালচার আর স্কুলের পথে, পাশের বাসার ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে যাওয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সন্তানকে হোম টিউটরের কাছে পড়তে দিবেন, দুশ্চিন্তা। সন্তানকে পাশের বাসার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে দিবেন, দুশ্চিন্তা। বাচ্চাকে বাইরের টিউটর বা কোচিং-এ পড়তে পাঠাবেন, আরও বেশি দুশ্চিন্তা। আবার বাসায় কোন আত্মীয়ের কাছে রেখে নিজেরা অফিস করবেন, মহাদুশ্চিন্তা। কিন্তু কেন এই দুশ্চিন্তা? হ্যাঁ, ধর্ষণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ধর্ষণের পরিমাণ এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, একে মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করাটাই যৌক্তিক হবে। কারণ, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি পরিসংখ্যান ও মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, শতকরা প্রায় ৮৫ টি ধর্ষণের ঘটনাই ঘটে আত্মীয়, পরিচিত বা বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুইমাসের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে মোট ধর্ষণের ধটনা ঘটেছে ৮৫ টি যার মধ্যে মামলা হয়েছে ৭০টি। এসকল ঘটনায় ৪ জন ভুক্তভোগী মারা গেছে এবং একজন পরবর্তীকালে আত্মহত্যা করেছে। এরকম পরিসংখ্যান আরও আছে তবে একটি বিষয়ে আমরা সবাই একমত হব যে, ধর্ষণের ধরন বদলেছে। যেমন একক ও গোপনে ধর্ষণের পাশাপাশি এখন সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যা, গুম করে রাখা ইত্যাদি ঘটনা  বেড়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, পরিস্থিতি এতটা খারাপ হওয়ার পিছনে কারণ কি? একবাক্যে সবাই স্বীকার করবেন যে, বিচারহীনতাই এই খারাপ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। হ্যাঁ, বিচারহীনতা, তবে এটিই একমাত্র কারণ নয়। ঘটনা ঘটার পরে বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পরবর্তীকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা অবশ্যই কার্যকর একটি পদ্ধতি। আবার আরেকটি পদ্ধতি হলো, ছোট-ছোট অপরাধগুলোকে রুখে দিয়ে বড় অপরাধগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে এই দুটিই অনুপস্থিত। বিচারহীনতার বিষয়ে পরে আসি, আগে আলোচনা করি ছোট ছোট অপরাধ নিয়ে। আমাদের অসচেতনতা ও দায়িত্ববোধহীনতার কারণে কোনো সেক্টরেই শৃঙ্খলা নেই। ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলবাজি ইত্যাদি তো আছেই পাশাপাশি নিজের ভালোটাও আমরা বুঝি না। পরিবেশের উন্নয়ন, কাঠামোগত উন্নয়ন, সেবার মান বৃদ্ধি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কথা বললেই আমরা মনে করি আমাদের বেঁধে রাখা হচ্ছে। চারদিকে অনিয়ম কিন্তু আমরা তা অবলীলায় সহ্য করে নিয়েছি। ফলে অনিয়ম যেমন বাড়ছে সঙ্গে অপরাধও বাড়ছে। ফুটপাত দখল করতে করতে রাস্তা পর্যন্ত দখল হয়ে যাচ্ছে অথচ আমরা চুপ করে আছি। স্কুলড্রেস পরা শিক্ষার্থী ধূমপান করতে করতে পাশ দিয়ে চলে গেল, আমার চোখ বন্ধ।  বোঝাতে গেলে যদি আমাকে অপমান করে বসে। এই যে চলছে রমজান মাস, সয়াবিন তেলের কাহিনী আমরা সবাই জানি। সরকারি অফিসগুলোতে ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না। অফিসাররা সংঘবদ্ধ, কিন্তু সেবাগ্রহীতারা কখনই সংঘবদ্ধ হতে পারেনি, পারেনি প্রতিবাদ করতে বা অভিযোগ জানাতে। অসাধু ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ আর ভোক্তারা জিম্মি। সরকারি ক্রয়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির ঘটনা আমরা জানি। বিচারের কথা বাদ দিলাম, জনগণ তো এ সকলের বিরুদ্ধে কখনই মাঠে নামেনি, প্রতিবাদ করেনি, দাবি জানায়নি বিচারের। বরং টি স্টলে মুখরোচক গল্পের অনুষঙ্গ হয়েছে এইসব অনিয়মের খবর। অনিয়ম আর অপরাধ সইতে সইতে আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছি যে, আমাদের কাছে এখন সব অপরাধই স্বাভাবিক। এবার আসি বিচারহীনতা প্রসঙ্গে। আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ এই ৩ বিভাগের সুসমন্বয়ে আমাদের নির্বাহী বিভাগ যা সংসদীয় সরকারের পূর্বশর্ত। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংসদে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইন পাশ ও প্রণয়ন হয়। বাংলাদেশে চমৎকার ও যৌক্তিক ধারা সংবলিত বহু আইন রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আইনের শাসন নেই।

খিলগাঁও, ঢাকা থেকে

×