
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়। ঋণ খেলাপির সংখ্যা ও পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। উল্লেখ্য, পত্র-পত্রিকার ভাষ্যমতে বর্তমান ঋণ খেলাপির পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থনৈতিক এই দুরবস্থার জন্য খেলাপি ঋণ হচ্ছে অন্যতম প্রধান কারণ। এজন্য ব্যবসায়ী হিসেবে ঋণ খেলাপি হওয়ার কিছু কারণ অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরা হলো।
মেয়াদি ঋণ : উদাহরণস্বরূপ, একজন উদ্যোক্তা ১০ কোটি টাকা ৬ বছর মেয়াদি ঋণ নিয়ে শিল্প স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করল। যেখানে তার মাসিক কিস্তি নির্ধারিত হয় ১৮ লাখ টাকা। কিন্তু, শিল্প স্থাপনে অতিরিক্ত সময় লাগা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ পেতে বিলম্ব, বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে দেরি হওয়াসহ নানাবিধ কারণে সঠিকভাবে ব্যাংকের কিস্তি তিনি পরিশোধ করতে পারেন না। ফলে, এক সময় তিনি ঋণ খেলাপিতে পরিণত হন। পরবর্তীতে ঋণ পুনঃতফসিলের সময় তার ঋণস্থিতি সংগত কারণে আরও বেড়ে যায়। তখন ক্যাশ ফ্লো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তার ঋণস্থিতি পরিশোধে প্রায় ১০ বছর সময় লেগে যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান সার্কুলারের মেয়াদ অনুযায়ী তিনি ৬ বছর সময় পান। এতে করে কিস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা তিনি পরিশোধ করতে সক্ষম হন না। যে কারণে পুনরায় ঋণ খেলাপিতে পরিণত হচ্ছেন। কাজেই, ঋণ খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে সার্কুলার অনুযায়ী মেয়াদ নির্ধারিত না করে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ক্যাশ ফ্লো বিশ্লেষণ করে পরিশোধের মেয়াদ নির্ধারণ করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, খেলাপি হওয়ায় অনেক কষ্ট করে ডাউন পেমেন্টের টাকা সংগ্রহ করলেও ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণের জন্য পুনঃতফসিলকৃত ঋণস্থিতির ওপর ২% কম্প্রোমাইজড এমাউন্ট জমা দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায়, গৃহীত ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণের ওপর ২% কম্প্রোমাইজড এমাউন্ট জমা দানের সুযোগ দেওয়া যায় কিনা, তা বিবেচনা করা যেতে পারে।
সিআইবি রিপোর্ট : গ্রুপ অব কোম্পানির উদোক্তাগণ বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ হিসাব পরিচালনা ও সংরক্ষণ করে থাকে। উপরন্তু, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে পরিচিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুরোধের প্রেক্ষিতে তাদের পক্ষে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করে থাকে। ফলে, উদ্যোক্তাগণ সব সময় এ সব ঋণের বা ব্যাংক গ্যারান্টির সর্বশেষ অবস্থা অবগত থাকে না। সেক্ষেত্রে সংগৃহীত ঈওই রিপোর্ট থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম উদ্ধার করা ও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে, নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এহেন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ এবং ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার জন্য ঈওই রিপোর্টে অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ এবং সংগৃহীত ঈওই রিপোর্টের ১টি কপি গ্রাহককে প্রদান অথবা গ্রাহক যাতে নিজে রিপোর্ট উত্তোলন করতে পারেন, সেই বিধান জারি করা উচিত।
অস্বাভাবিক সুদ আরোপ : দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা, বেকারত্ব হ্রাস, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ইত্যাদির লক্ষ্যে শিল্পপতিরা ব্যাংক থেকে ১৩%-১৪% সুদে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে শিল্প স্থাপন করেন। ওভারডিউ হয়ে গেলে সুদের হার ২% যোগ হয়ে যায় এবং ব্যাংকের বিভিন্ন চার্জসহ দাঁড়িয়ে যায় প্রায় ১৭%-১৮%। লিজিং কোম্পানি হতে ঋণ গ্রহণ করলে সেটার সুদের হার আরও বেশি দাঁড়ায়। ব্যাংকের এই অস্বাভাবিক সুদ পরিশোধ করতেই শিল্পপতিদের মূলধন ঘাটতি দেখা দেয়। কয়েক বছর পার হলেই দেখা যায় ব্যাংক তার আসল উঠিয়ে নিয়েছে। আর শিল্প উদ্যোক্তারা এক রকম বাধ্য হয়েই ঋণ খেলাপির দিকে ধাবিত হচ্ছেন।
ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ: শিল্পপতিদের ঋণ খেলাপি হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ প্রয়োজনীয় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ প্রদান না করা। শিল্পপতিদের ফ্যাক্টরি স্থাপন, মেশিনারিজ আমদানি ও ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য শত কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে ব্যাংক। কিন্তু কোনো ধরনের দুর্যোগ বা কোনো সমস্যা তৈরি হলে, ব্যাংক ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ প্রদানের সময় গড়িমসি শুরু করে। ব্যাংক তখন গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনায় না নিয়ে তাদের ইচ্ছামতো এ ঋণ প্রদান করে। তাছাড়া, টার্গেট অনুযায়ী রপ্তানি করার মতো প্রয়োজনীয় মেশিনপত্র থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক প্রয়োজনীয় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ দেয় না। যে কারণে শুধু প্রয়োজনীয় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ প্রদান না করার কারণে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
নিয়মবহির্ভূত তারিখবিহীন খালি চেক গ্রহণ : কমার্শিয়াল ব্যাংক গ্রাহকের নিকট জমি, ভবন, মেশিনারিজ ও সহায়ক জামানত বন্ধক গ্রহণ করে সাধারণত ঋণ প্রদান করে। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বন্ধক গ্রহণ করে ঋণ প্রদানের পর কোনো ধরনের চেক গ্রহণ করার বিধান আইনে নেই। অথচ, কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের বিপরীতে তারিখবিহীন ও পরিমাণ উল্লেখ ছাড়া খালি চেক প্রদান করতে বাধ্য করে। গ্রাহক যখন ঋণ খেলাপি হয়, ফ্যাক্টরি যখন বন্ধের উপক্রম হয়, তখন গ্রাহকের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ আলোচনা না করে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের নিকট থেকে অনৈতিক ও অন্যায়ভাবে গ্রহণ করা চেকে খেয়াল খুশিমতো টাকা বসিয়ে চেক ডিজঅনার করে আদালতে মামলা করে।
এককালীন এক্সিট : বিআরপিডি সার্কুলার নং ১৩ তাং ০৮.০৭.২০২৪ অনুযায়ী ঋণগ্রহীতার ব্যবসা, শিল্প বা প্রকল্প কখনো বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে বন্ধ হয়ে যায়। কিংবা লোকসানে পরিচালিত হলে সেই গ্রাহক ওয়ান টাইম (এককালীন) এক্সিট সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। উল্লেখ্য, উক্ত সার্কুলার অনুযায়ী বিদ্যমান ঋণ স্থিতির ১০০% ডাউন পেমেন্ট হিসেবে পরিশোধ করে অবশিষ্ট ঋণস্থিতি অনধিক ৩ বছরে পরিশোধ করতে হয়। উল্লেখ্য, আর্থিক দুরবস্থার কারণেই যেহেতু তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, সেহেতু তাকে ধার-দেনা করে ১০% ডাউন পেমেন্টের টাকা পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক : ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক হতে কোনো প্রস্তাব (ঋণ প্রদান ও সময় বৃদ্ধি/কিংবা কোনো বিষয়ে এনওসি আনার জন্য ফাইল পাঠালে, তাতে বাংলাদেশ ব্যাংক গুরুত্ব দেয় না। অযাচিতভাবে নানা রকমের অপ্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়, যা অনেক সময় গ্রাহক জানতেও পারেন না। তাছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা কঠিন এবং অনেক সময় তারা সাক্ষাৎ দিতেও চান না। আবার, সাক্ষাৎ দিলেও তারা তেমন সহযোগিতা করেন না। অন্যদিকে, প্রেরিত ফাইল ফেরত পাঠাতে কয়েক মাস সময় লাগিয়ে দেয়। এই সময়ের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সুদ চার্জ অব্যাহত রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন না দেওয়ায় গ্রাহক তার ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। এতে গ্রাহক চরম ক্ষতির মুখে পড়ে যান। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও সচেতন হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ব্যবসাবাণিজ্য সম্পর্কে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। যে কারণে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পরিদর্শনের সময় সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণটি আদায়ের সম্ভাবনা থাকায় ব্যাংককে খেলাপি করতে না চাইলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে খেলাপি করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এমনকি মামলা-মোকদ্দমা করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। তারা কখনো যাচাই করতে চায় না কিংবা যাচাই করে না, কেন একজন গ্রাহক ঋণ খেলাপি হচ্ছেন? কেন গ্রাহক কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না? কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে? এগুলোর উত্তর সঠিকভাবে খুঁজলে দেশে ঋণ খেলাপি সৃষ্টি হতো না বলে আমরা মনে করি।
লেখক : চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, গিভেন্সী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লি., প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র