
মাগুরার শিশুটির মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের সমাজকে একটা তীব্র ঝাঁকুনি দিয়েছে। আমাদের জানিয়ে দিয়েছে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় আমরা কত অসভ্য! শিশু নির্যাতন-নিপীড়ন এখন একটা মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এক সপ্তাহের কম সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একই বয়সের কাছাকাছি কয়েকটি শিশুর ধর্ষণের খবর গণমাধ্যমে এসেছে, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কেউ ধর্ষণের শিকার শিশুর প্রতিবেশী, আবার কেউ নিকটাত্মীয়।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারী ও শিশু। তাদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ওয়েবসাইট ও আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গবেষণা প্রতিবেদনে নারী নির্যাতনের নানা তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণের পর হত্যার দুটি ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে পাঁচ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীও রয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী রয়েছেন। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনজন কিশোরী ও ১৪ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুজন নারী। এছাড়াও ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এ মাসে।
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ছিল দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে বেশি। এছাড়া পারিবারিক সহিংসতা ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বিগত মাসগুলোর মতো একই ধারাবাহিকতায় ঘটেছে, যা ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নতুন একটি গবেষণার তথ্য বলছে, শুধু ঢাকা মহানগরে যত শিশু নির্যাতনের শিকার হয় তার প্রায় ৭৬ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। এসব শিশুর মধ্যে ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশু বেশি। ‘শিশু যৌন নির্যাতন : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে দায়েরকৃত মামলার ওপর একটি গবেষণা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ঢাকা শহরে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সী স্কুল ও কলেজের ১০০ শিক্ষার্থী এবং ৫০ পথশিশুর ওপর জরিপ চালানো হয়। এতে ২৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে ৩ হাজার ৪৩৮টি শিশু ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে আরও বেশি। তাদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে আছে ৯৩৩ জন। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিচিতদের দ্বারাই শিশুরা যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়। নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা অধিকার কর্মীরা বলছেন, মূলত নিকটাত্মীয়ের প্রতি যে বিশ্বাস থাকে, তা ব্যবহার করেই এই ধরনের কাজগুলো করা হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন তারা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি নিবন্ধ অনুযায়ী, ‘শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারীরা শিশুর পরিচিত, হয় তার আত্মীয়, বন্ধু বা বিশ্বস্ত কেউ। শিশুদের ওপর হওয়া যৌন নিপীড়ন নিয়ে ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘চাইল্ড সেক্সুয়াল এবিউজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাতেও বলা হয়েছে, দুর্বৃত্তরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীর পরিচিত কেউ থাকেন। নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে শিশুদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়টি ‘নতুন কিছু না’ হিসেবে উল্লেখ করে অধিকারকর্মী শাশ্বতী বিপ্লব বলেন, ‘এটা সবসময় শিশুদের জীবনের বাস্তবতা। কাকা-মামা এরকম যারা আছে, তাদের কাছেই তো আমরা তাদের (শিশুদের) দেই বা তারা তাদের কাছে যায়। কারণ, তারা মনে করে এরা আপন লোক, পরিবারের লোক। সেই সুযোগটাই একজন পেডোফাইল (শিশুকামী) পায়, সম্পর্ক যাই হোক না কেন? কিছু মানুষ তার অবদমিত ইচ্ছা পূরণের জন্য সহজ রাস্তা খোঁজেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ উপায় থাকে পরিবারের শিশু। বাইরের মানুষের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের প্রিকশন (সতর্কতামূলক ব্যবস্থা) নেওয়া হয়। কোথায় যাচ্ছে? কার সঙ্গে যাচ্ছে? কিন্তু মামা-চাচাদের ক্ষেত্রে প্রশ্নগুলো করা হয় না। এ পরিজনদের সবাই বিশ্বাস করে। ফলে তারা সহজেই এক্সেস পায়। আমাদের আইনে ছেলে শিশু ধর্ষণের ব্যাপারে কিন্তু কিছু বলা নেই। আইনের সংজ্ঞায় ছেলে শিশুরাও যে ধর্ষণের শিকার হতে পারে, এ ধারণাটাই স্বীকার করে না।
বাংলাদেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, কেবল ২০২৪ সালেই ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি, তবে মামলা হয়েছে ২৪টি। ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে তিনটি। আর ইউনিসেফ বলছে, সারা বিশ্বে হিসাব করলে এ সংখ্যা ২৪ থেকে ৩১ কোটি। অর্থাৎ প্রতি ১১ জনে একটি ছেলে শিশু শৈশবে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়- বলছিলেন এ খাত নিয়ে কাজ করা একাধিক অধিকারকর্মী। ছেলে শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও খুব কম ক্ষেত্রেই এ নিয়ে জনসচেতনতা দেখা যায়।
এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে কমিটি করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও সেটার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। অধিকারকর্মীরা বলছেন, নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন করতে পারলে, এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি সবসময়ই বাংলাদেশে দেখা যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা ‘খুবই খারাপ’ এবং প্রায় কোনো ধরনের জবাবদিহি না থাকার কারণে শিশুদের সঙ্গে হওয়া যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। সমাজের মধ্যে আসলে প্রচুর পেডোফাইল (শিশুকামী) আছে। ল’ অ্যান্ড অর্ডার না থাকায় একটা কডিউসিভ এনভারনমেন্ট (সহায়ক পরিস্থিতি) তৈরি হয়েছে চারদিকে যে, ‘আমি যা খুশি করতে পারি!’
২০২৩ সালের নভেম্বরে ঢাকা মেট্রোপলিটনের শিশুদের ওপর হওয়া যৌন সহিংতা নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে শিশুদের যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। যেমন- শিশুদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে নির্যাতনকারীর যৌনতৃপ্তি লাভ কিংবা নিজেকে নিয়ে পৌরুষোচিত চিন্তা এক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়। এছাড়াও শিশুর বাহ্যিক সৌন্দর্যকেও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শিশু কোন পরিবেশে থাকছে, সে বিষয়টিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- সুবিধাবঞ্চিত বা বিপজ্জনক স্থানে থাকা শিশুরা থাকে বেশি ঝুঁকিতে। একই কথা বলা হচ্ছে নিম্নবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রেও।
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, বৈরী মনোভাব, পারিবারিক দ্বন্দ্বসহ আরও কিছু বিষয়কে শিশু নিপীড়ন ও ধর্ষণের কারণ হিসেবে গবেষণাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। শিশুদের যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঠিক উন্নতি। অপরাধীরা যে কয়টি কারণে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকে, তার বড় একটি কারণ হলো সাজার ভয়। একসময় বাংলাদেশে এসিড সহিংসতা ছিল অনেক বেশি। সরকার তৎপর হওয়ার পর তা কমেছে। একইভাবে যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করে কঠোর শাস্তির কিছু উদাহরণ তৈরি করা হয়, এটা কমে আসবে।
তবে কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করেই শিশুদের সঙ্গে হওয়া যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা। কারণ, অনেক ঘটনাই পুলিশ পর্যন্ত আসে না। সেক্ষেত্রে অভিভাবকদের দিক থেকে সচেতনতা এবং নজরদারি বাড়ানো এবং শিশুদের এ বিষয়ে শেখানো প্রয়োজন। বিশেষ করে, অভিভাবকদের মধ্যে এ বিষয়ে তেমন সচেতনতা না থাকায় তারা সস্তানদেরও সচেতন করে তুলতে পারছেন না। যার ফলে ভুগতে হচ্ছে শিশুদের। অনেক সময় তারা বুঝতেই পারে না যে, তাদের সঙ্গে কী ঘটছে। ফলে এ ঘটনাগুলোকে আলাদা করে বাবা-মাকে বলতে পারে না শিশুরা। সেক্ষেত্রে সবার আগে সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে বাবা-মায়ের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কেবল ঘরের বাইরে বা অপরিচিতদের ক্ষেত্রেই নয়, পরিচিত-নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে।
২০২০ সালের আইনে বলা আছে- (১) যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। (২) যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে (ধর্ষণের শিকার) নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূনতম এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। তবে আইন থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ প্রায় নেই। কথায় আছে যে, ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নাই’। আমাদের দেশের অবস্থাও তাই। বহু আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। আর আইনের প্রয়োগ না থাকলে অপরাধ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। শিশু নির্যাতন কমাতে বা বন্ধ করতে হলে কঠোর আইন, এর কার্যকারিতা এবং দ্রুত বিচার অত্যাবশ্যক।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন