
একটি ছোট্ট ঘরে নিঃশব্দে বসে আছে কেউ। চারপাশের দেয়ালগুলো যেন ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। একসময় যে হাসতে ভালোবাসত, আকাশের তারা গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়ত, সে ই এখন রাতভর জেগে থাকে- অকারণে, অজানা এক শূন্যতার মধ্যে হারিয়ে গিয়ে। মানুষজনের ভিড়েও সে একা, নিজের মধ্যেই যেন এক অতল গহ্বরে ডুবে গেছে। কারও চোখে ধরা পড়ে না তার কষ্ট। কেউ বুঝতে চায় না তার নিঃসঙ্গতা। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই জীবন হয়তো অর্থহীন। এই বেঁচে থাকাটাই বোঝা হয়ে গেছে তার জন্য।
তার মায়ের চোখে গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ। কিন্তু তার মনে হয়, মায়ের ভালোবাসাও তাকে আর আগের মতো উষ্ণতা দিতে পারে না। বন্ধুদের ডাকে সাড়া দিতে ইচ্ছে করে না। প্রিয় বইয়ের পাতাগুলোও এখন নিস্তেজ লাগে। বিষণ্নতার কালো ছায়া তার হৃদয়ের প্রতিটি কোণে গেঁথে গেছে। কেউ যদি একটু হাত বাড়িয়ে দিত, কেউ যদি একটু বুঝতে চাইত তার নিঃসঙ্গতা! অথচ সমাজ তাকে শুধুই অলস বা উদাসীন ভাবছে। বুকের ভেতর জমে থাকা কান্নাগুলোও আর গলায় উঠে আসে না। হারিয়ে যায় এক নীরব যন্ত্রণায়।
বিষণ্নতা আজকের সমাজে এক নীরব মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছে। অথচ বেশিরভাগ মানুষ বিষণ্নতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে না। বিষণ্নতাকে অনেকেই সামান্য মন খারাপ বা সাময়িক দুঃখবোধ মনে করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এটি শুধু কিছুদিনের জন্য মন খারাপের অনুভূতি নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি মানসিক অবস্থা, যা একজন মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে এবং দিন দিন এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশেও বিষণ্নতা একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৩ জন কোনো না কোনো পর্যায়ে বিষণ্নতায় আক্রান্ত। কিন্তু সমাজে এখনো বিষণ্নতাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মানুষ একে দুর্বলতার লক্ষণ বা ইচ্ছাকৃত আচরণ বলে মনে করে। অথচ এটি একটি স্বীকৃত মানসিক রোগ, যার জন্য যথাযথ চিকিৎসা প্রয়োজন।
অনেক সময় বিষণ্নতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, আক্রান্ত ব্যক্তি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে এবং বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে, যার একটি বড় অংশ বিষণ্নতায় আক্রান্ত। বিষণ্নতা এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে দুঃখবোধ, আগ্রহের অভাব, আত্মবিশ্বাসের সংকট এবং জীবনের প্রতি অনীহা অনুভব করে। এটি সাধারণ মন খারাপের মতো নয়, যা কয়েকদিন পর কেটে যায়। বরং এটি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং ব্যক্তির জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
বিষণ্নতার কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো দীর্ঘ সময় ধরে বিষণ্ন অনুভব করা, যে কাজ আগে ভালো লাগত, সেটাতে আগ্রহ হারানো, ঘুমের সমস্যা যেমন অতিরিক্ত ঘুমানো বা অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা বা অতিরিক্ত খাওয়া, ক্লান্তি ও শক্তিহীনতা, অযৌক্তিক ভয়, দুশ্চিন্তা ও অপরাধবোধ, আত্মহত্যার চিন্তা করা ইত্যাদি। বিষণ্নতা শুধু মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে না, এটি শারীরিকভাবেও মানুষের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী বিষণ্নতা হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং স্নায়ুর সমস্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। বিষণ্নতার পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে এবং এটি মূলত জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও পরিবেশগত কারণের সংমিশ্রণে ঘটে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিষণ্নতার একটি জিনগত ভিত্তি রয়েছে। অর্থাৎ, যদি পরিবারের কেউ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে অন্য সদস্যদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বিষণ্নতার জন্য প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ দায়ী হতে পারে বংশগত কারণ। এছাড়া মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা বিষণ্নতার অন্যতম কারণ হতে পারে। সেরোটোনিন, ডোপামিন এবং নোরএপিনেফ্রিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা বিষণ্নতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া মানসিক স্থিতিশীলতা বিষণ্নতার অন্যতম কারণ হতে পারে। অতীতে কোনো বড় মানসিক আঘাত পাওয়া, যেমনÑ শৈশবে নির্যাতন, ভালোবাসার মানুষকে হারানো, সম্পর্কের ভাঙন ইত্যাদি বিষণ্নতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সমাজের বিভিন্ন চাপেও বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে। একাকিত্ব, অর্থনৈতিক সমস্যা, কর্মক্ষেত্রের চাপ, পারিবারিক কলহ এগুলো বিষণ্নতার সামাজিক কারণের মধ্যে অন্যতম। এছাড়া জীবনধারাগত কিছু কারণও বিষণ্নতার পেছনে দায়ী থাকতে পারে। অপর্যাপ্ত ঘুম, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মাদকের ব্যবহার ইত্যাদিও বিষণ্নতার কারণ হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন না এবং যারা অতিরিক্ত প্রসেসড ফুড বা ফাস্টফুড খান, তাদের মধ্যে বিষণ্নতার হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
বিষণ্নতা শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি পুরো সমাজের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিষণ্নতা পারিবারিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিষণ্ন ব্যক্তির আচরণ পরিবর্তিত হয়, যা পারিবারিক সম্পর্কে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। বাবা-মা বিষণ্ন হলে, তাদের সন্তানরাও মানসিক চাপে ভুগতে থাকে। কর্মক্ষেত্রেও বিষণ্নতা ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিষণ্নতা একজন ব্যক্তির কাজের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দেয় এবং তার কর্মদক্ষতা কমিয়ে দেয়। যার ফলে অর্থনৈতিকভাবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিষণ্ন ব্যক্তি ধীরে ধীরে সামাজিক জীবন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একাকিত্ববোধ ও আত্মবিশ্বাসের অভাব তাকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। বিষণ্নতা নিরাময়যোগ্য, তবে সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি গুরুতর রূপ নিতে পারে। বিষণ্নতার চিকিৎসার জন্য মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি কার্যকর হতে পারে। কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি বা সিবিটি বিষণ্ন ব্যক্তিকে নেতিবাচক চিন্তা পরিবর্তনে সহায়তা করে। এছাড়া ইন্টারপার্সোনাল থেরাপি ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্ক উন্নত করতে সাহায্য করে। বিষণ্নতার চিকিৎসায় ওষুধও ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এগুলো গ্রহণ করা উচিত নয়। জীবনধারার পরিবর্তন বিষণ্নতা নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম করা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, ধ্যান ও মেডিটেশন করা বিষণ্নতা দূর করতে সহায়তা করে। বিষণ্ন ব্যক্তির পাশে থাকা এবং তাকে বোঝানো যে, সে একা নয়, এটাও বিষণ্নতা নিরাময়ে সাহায্য করতে পারে। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলাও বিষণ্নতা কমাতে পারে।
বিষণ্নতা একটি ভয়ংকর রোগ, তবে সঠিক চিকিৎসা ও সচেতনতার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমাদের উচিত বিষণ্নতাকে দুর্বলতা হিসেবে না দেখে এটিকে একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করা। পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের উচিত বিষণ্ন ব্যক্তিকে সহায়তা করা এবং তার পাশে দাঁড়ানো। শুধু ভালোবাসা ও সহানুভূতিই পারে বিষণ্নতার অন্ধকার থেকে কাউকে মুক্ত করতে। আমাদের সবার দায়িত্ব বিষণ্নতা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং একে জয় করার পথ খুঁজে বের করা।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়