
আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে শিকড় গেড়েছে পুঁজিবাদ
বিগত ২০০ বছরে বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে স্বীকৃত একটি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে শিকড় গেড়েছে পুঁজিবাদ। যার অন্যতম মূলমন্ত্র বা দর্শন হচ্ছে ব্যক্তি-উদ্যোগের অবাধ স্বাধীনতা। ইতিহাস বলে, মানুষ যখন তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ বিকশিত করার অফুরান স্বাধীনতা ভোগ করে, সমাজ তথা রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়।
পুঁজিবাদ নিঃসন্দেহে বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। তবে, এই জনপ্রিয় আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার কিছু দুর্বলতাও রয়েছে। পুঁজিবাদে মুনাফা এবং ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলশ্রুতিতে কিছু সংখ্যক মানুষ অত্যধিক ধনী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, অসংখ্য মানুষ বঞ্চিত হয় তাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে মাত্র ৪২ জন ধনী ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ ৩৭০ কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সম্পদের সমান। প্রায় ২০ কোটি মানুষ বেকার বা কর্মহীন। প্রতি দশজনে একজন অপুষ্টির শিকার। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ভুগছে নয়জনের মধ্যে একজন। আনুমানিক ১৬০ কোটি মানুষ বিশ্বব্যাপী গৃহহীন। আশঙ্কাজনকভাবে সামাজিক বিভাজন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েই চলেছে।
বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও মানবজাতির মৌলিক প্রশ্নটি থেকে যায়Ñ আমরা কি সত্যিই সুখী? দিনশেষে সুখে থাকা বা সুখী হওয়া মানুষের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০১২ সালে সর্বজনীন লক্ষ্য হিসেবে সুখ এবং কল্যাণকে স্বীকৃতি দিয়েছে; আহ্বান জানিয়েছে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সংগত এবং ভারসাম্যপূর্ণ আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার, যা মানুষের সুখ এবং কল্যাণকে নিশ্চিত করবে।
২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব মানুষের জীবনে সুখ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নতুন অর্থনৈতিক প্যারাডাইম (এনইপি) নামের একটি প্রকল্প চালু করা হয়। ২০১৯ সালে এ প্রকল্প থেকে বিশ্বের সব রাষ্ট্র ও মানুষকে ‘পুঁজিবাদ’ বা ‘ক্যাপিটালিজমের’ পরিবর্তে ‘হ্যাপিটালিজম’ নামক নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আহ্বান জানানো হয়।
হ্যাপিটালিজম হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দর্শন, যা মূলত সব মানুষের স্বাধীনতা, মঙ্গল ও সুখের নিশ্চয়তা বিধান করবে। এই ধারণাটি শুধু ব্যক্তিগত সুখের ওপরই জোর দেয় না, বরং সমাজ, পরিবেশ এবং অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপরও গুরুত্বারোপ করে।
হ্যাপিটালিজম এমন এক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, যেখানে মানুষের সুখ এবং কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এটি শুধু অর্থনৈতিক সাফল্য বা জিডিপি বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে না, বরং মানুষের মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক সুস্থতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, এমন একটি সমাজ গঠন করা, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি তার পরিপূর্ণ সম্ভাবনা বিকশিত করার সুযোগ পাবে এবং একইসঙ্গে সমাজ ও পরিবেশের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে।
এই ধারণাটি প্রথাগত পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র থেকে আলাদা। পুঁজিবাদ মুনাফা এবং ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনকে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে সমাজতন্ত্র সমষ্টিগত কল্যাণ এবং সম্পদের সমবণ্টনকে গুরুত্ব দেয়। হ্যাপিটালিজমে এই দুটি ধারণার মধ্যে সমন্বয় করা হয়, যেখানে ব্যক্তির সুখ এবং সামগ্রিক কল্যাণকে একসঙ্গে বিবেচনা করা হয়।
আধুনিক বিশ্বে হ্যাপিটালিজমের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র উভয়ই তাদের সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষের প্রকৃত সুখ এবং কল্যাণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। পুঁজিবাদে অর্থনৈতিক অসমতা এবং পরিবেশগত অবক্ষয় বাড়ছে। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং উদ্ভাবন সীমিত হয়ে পড়েছে। হ্যাপিটালিজম এই দুটি ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনের চেষ্টা করে।
হ্যাপিটালিজমের ধারণাটি প্রাচীন দর্শন, ধর্ম এবং আধুনিক চিন্তাভাবনার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল সুখকে ‘ইউডাইমোনিয়া’ (ঊঁফধরসড়হরধ) হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা শুধু আনন্দ নয়, বরং জীবনের পূর্ণতা এবং উদ্দেশ্য অর্জনের মাধ্যমে অর্জিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মে সুখের ধারণাটি মানসিক শান্তি এবং নির্বাণের সঙ্গে জড়িত। এটি ব্যক্তির আত্মিক উন্নতি এবং সামাজিক সম্প্রীতির ওপর জোর দেয়।
সকল ধর্মে ব্যক্তির আত্মিক উন্নতি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে অর্জিত হবে সুখ এবং কল্যাণ। জেরেমি বেনথাম এবং জন স্টুয়ার্ট মিলের উপযোগবাদ (টঃরষরঃধৎরধহরংস) তত্ত্ব সুখের ধারণাকে একটি দার্শনিক ভিত্তি প্রদান করে। তাঁদের মতে, সমাজের লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক সুখ’ অর্জন করা।
১৯৭২ সালে ভুটানের তৎকালীন রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক প্রথমবারের মতো ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ (জিএনএইচ) ধারণাটি উপস্থাপন করেন। এটি শুধু অর্থনৈতিক সাফল্য নয়, বরং মানুষের সুখ এবং কল্যাণকে পরিমাপ করার একটি সূচক। ভুটানের এই উদ্যোগ হ্যাপিটালিজমের ধারণাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলে।
নিউজিল্যান্ড সরকার ২০১৯ সালে একটি ‘সুখ বাজেট’ প্রণয়ন করে, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য, শিশু কল্যাণ এবং পরিবেশগত সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ডেনমার্কের হাইজ সংস্কৃতি হলো হ্যাপিটালিজমের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই সংস্কৃতিতে সহজ জীবনযাপন, পারিবারিক বন্ধন এবং সামাজিক সংহতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
হ্যাপিটালিজমের ধারণাকে বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। নি¤œলিখিত পদক্ষেপগুলো এই ধারণাকে বাস্তবায়নে সাহায্য করতে পারেÑ
১. শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি : হ্যাপিটালিজমের মূলনীতিগুলোকে শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা এবং পর্যাপ্ত জ্ঞান দিতে হবে।
২. সরকারি নীতির পরিবর্তন : সরকারকে এমন নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে মানুষের সুখ এবং কল্যাণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভুটানের ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ সূচক ব্যবহার করা, যা শুধু অর্থনৈতিক সাফল্য নয়, বরং মানুষের সুখ এবং কল্যাণকে পরিমাপ করবে।
৩. শ্রমিকদের কল্যাণের প্রতি মনোযোগ : ব্যবসায়ীদের উচিত তাদের কর্মীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং মানসিক কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া। যেমনÑ নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রকল্প চালু করা। শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে আইনের সংস্কার এবং যথাযথ প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. গ্রাহকের সন্তুষ্টি : গ্রাহকদের প্রয়োজনের প্রতি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মনোযোগ দিতে হবে। তাদের প্রতিক্রিয়া এবং মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রাহক সন্তুষ্টি বাড়াতে হবে।
৫. সামাজিক দায়বদ্ধতা : ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সামাজিক এবং পরিবেশগত দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তারা এমন প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে যা সমাজের সুখ এবং কল্যাণ বাড়াতে সাহায্য করে। প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে এই দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. স্থিতিশীল উন্নয়ন : ব্যবসায়ীদের উচিত তাদের কার্যক্রমকে স্থায়ী উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়া। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগতÑ সব দিক থেকে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৭. সমাজের অংশগ্রহণ : হ্যাপিটালিজমের সাফল্যের জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। সরকার, স্থানীয় সম্প্রদায়, এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো মিলে এই ধারণাকে এগিয়ে নিতে হবে।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা স্বীকার করে, মানবজাতির সুখ এবং সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার নতুন ব্যবস্থা- হ্যাপিটালিজম এখন সময়ের দাবি।
লেখক : একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক