ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৯ মার্চ ২০২৫, ৫ চৈত্র ১৪৩১

এজেন্ডা সেটিং তত্ত্ব এবং মিডিয়ার কপটতা

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৩৮, ১৮ মার্চ ২০২৫

এজেন্ডা সেটিং তত্ত্ব এবং মিডিয়ার কপটতা

মিডিয়ার এজেন্ডা সেটিং তত্ত্ব’র আবিষ্কারক লিঙ্কন স্টিফেন্স

গত শতকের তিরিশের দশকে ‘মিডিয়ার এজেন্ডা সেটিং তত্ত্ব’র আবিষ্কার করেছিলেন নিউইয়র্কের ‘ইভনিং পোস্ট’ পত্রিকার সাংবাদিক লিঙ্কন স্টিফেন্স। কোন ঘটনাকে মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করতে গণমাধ্যমের শক্তিশালী ভূমিকা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি একটি নিরীক্ষা করেন। সে সময় নিউইয়র্কে প্রায় প্রতিদিন ছোটখাটো সন্ত্রাস ঘটত, যা পত্রিকার খবর হয়ে আসত না।

লিঙ্কন স্টিফেন্স এক্সপেরিমেন্টের জন্য এ বিষয়টি বেছে নেন। এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে তিনি ইভনিং পোস্টে জমা দেন। প্রতিবেদনটি ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘ইভনিং সান’ নামে আরেকটি পত্রিকার অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদকের ওপর চাপ আসে বিষয়টির খোঁজখবর করে প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য।
ইভনিং সানে ছাপা হওয়ার পর অন্যান্য পত্রিকায়ও এ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হতে থাকে। শহরের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। শহরে কি সত্যিই সন্ত্রাস বেড়ে গেল? পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে এলো- না সন্ত্রাস বা অপরাধের হার বাড়েনি; বেড়েছে পত্রিকায় এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের হার। 
এই এজেন্ডা সেটিং তত্ত্বের সঙ্গে এ দেশের টেলিভিশন দর্শকও পরিচিত। হয়তো টার্মটি তারা অনেকে জানেন না; কিন্তু ঘটনাগুলো তো দেখছেন। সব চলছে গতানুগতিকÑ হঠাৎ একদিন শিশু নির্যাতনের রোমহর্ষক এক প্রতিবেদন প্রচার হলো কোন টেলিভিশন চ্যানেলে; এরপর কমপক্ষে মাসখানেক দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিনব ও অমানবিক সব শিশু নির্যাতনের ওপর প্রতিবেদন আসতে থাকল।

তারপর এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য নেই। কিছুদিন চুপচাপ তারপর হয়তো দেখা গেল পাচার নিয়ে ঠিক একই ধরনের প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশ হচ্ছে। তারপর আবার বিরতি এবং আবার নতুন ঘটনা। কোন কোন ঘটনা হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে এত হাইভোল্টে ঝলসে ওঠে যে মনে হয় এবার একটা এসপার ওসপার হবেই; কিন্তু মাসখানেক টানটান গর্জনের পর দেখা গেল বর্ষণ জিরো। হঠাৎ যেমন ঝলসে উঠেছিল তেমনি হঠাৎই হাওয়া। নিকট অতীতের দুয়েকটি ঘটনা এখনো নিশ্চয়ই পাঠকের মনে আছে।
অনেক কারণেই এমন হয়। যেমন অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা, যা জনগণ থেকে আড়াল রাখা দরকার বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এক হাত দেখিয়ে দেওয়ার আগাম ঢাল হিসেবেও অনেক সময় নাটকীয় আবহ তৈরি করা হয়। আরও নানা ধরনের কারণ থাকে এর পেছনে। তবে সেকালের প্রয়োগ আর একালের প্রয়োগের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর।

মিডিয়ার চরিত্র আমূল বদলে গেছে। গত শতকের আশি-নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত মিডিয়ার চরিত্র ছিল জাতীয়। স্থানীয় ও বৈশ্বিক সংবাদ সংস্থাগুলো পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে সংবাদ পরিবেশন করত। রেডিও টেলিভিশন চলত সরকারি মালিকানায়। বলা যায় আশির দশক থেকেই এ চিত্রে চিড় ধরা শুরু। ওই দশকে রোনাল্ড রিগ্যান এবং মার্গারেট থ্যাচার নিজ নিজ দেশে যে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োগ ঘটান তার প্রথম এবং অন্যতম অভিঘাত লাগে মিডিয়ায়।

আবির্ভাব হয় বেসরকারি ও বাণিজ্যিক রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র বা করপোরেট মিডিয়ার। নব্বই দশকের শুরুতে রিগ্যান-থ্যাচার যুগলের অর্থনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা ‘বিশ্বায়ন’ নাম নিয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বিশ্বের আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেলে মিডিয়ার ভূমিকা হয় মূলত এর সতর্ক পাহারাদার এবং রক্ষকের। তথাকথিত বিশ্বায়নের প্রসারের প্রয়োজনই বৈশ্বিক মিডিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।

যাতে মিডিয়ার ‘জাতীয়’ বা স্থানীয় চরিত্র বিলীন হয়ে অবধারিতভাবে হয়ে ওঠে বহুজাতিক। সংবাদ, সাংবাদিকতা সর্বোপরি তথ্য নিজেই পরিণত হয় বিপণনযোগ্য পণ্যে।
নব্বই দশকের শেষ দিকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ঊনসত্তরটি সদস্য দেশের সরকার তাদের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বেসরকারি খাতের মালিকদের জন্য উন্মুক্ত করলে আইবিএম, মাইক্রোসফট এবং এ ধরনের অন্যান্য কোম্পানির বিশ্বের যে কোনো দেশে প্রবেশের অবাধ সুযোগ নিশ্চিত হয়। এসব তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ও মিডিয়া নিজেরাই এখন বৃহত্তর একেকটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অন্যতম ভিত্তিও এখন এরা।
সামাজিক সেবা বা আদর্শভিত্তিক সংবাদ বলে এখন প্রায় কিছু নেই। একচেটিয়া পুঁজির মুনাফা নিশ্চিত করলেই কেবল কোন ‘খবর’ খবর হবে নইলে না। এই সত্য কথাটি আড়াল করার জন্য কপট গাম্ভীর্য নিয়ে নানা তত্ত্বের অবতারণা করে পশ্চিমে প্রচুর হচ্ছে লেখালেখি। মূল ধারার সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক মাধ্যম।

এসবের গুরুত্বকে কোনভাবেই উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব না। কিছুদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত এক কাগজে ফেসবুকে দেয়া তথ্যের বিরোধিতা করে এর সংবাদ মূল্য উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই ফেসবুক টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি এখন বিকল্প সংবাদের নির্ভরযোগ্য উৎস।

হ্যাঁ আবর্জনা আছে প্রচুর কিন্তু মুনাফার পারপাস সার্ভ করে না এমন বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সামান্য হলেও এখান থেকে পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে আমাদের মনে পড়বে বছর কয়েক আগে ভারতের হায়দরাবাদ ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র আন্দোলনের কথা।
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সেকুলার ইমেজ যে সংকটে পড়েছে তা থেকে বাদ যায়নি শিক্ষা। পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় বিদ্বেষপূর্ণ লেখাসহ সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়েছিল প্রকটভাবে। রোহিত ভেমুলা নামে হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দলিত ছাত্র বর্ণবাদের প্রত্যক্ষ শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। পিএইচডির ছাত্র রোহিত ভেমুলা একজন দলিত এবং হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত ছাত্র সংগঠন আম্বেদকর স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

দলিত ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে দাবি ওঠানোর অভিযোগে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার পিএইচডি ভাতা মাসিক ২৫ হাজার টাকা বন্ধ করে দেয়। এর কিছুদিন পর সংগঠনের আরও চার সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় এই বলে যে, তারা আরএসএসের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি) কর্মসূচির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে।

এই অজুহাতে বিজেপির স্থানীয় এক নেতার নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রোহিতসহ বাকি চারজনকে হল থেকে বহিষ্কার করে। প্রতিবাদে অনশনে নামেন তারা। দীর্ঘসময় অনশন করলেও কর্তৃপক্ষ দৃষ্টি না দেয়ায় রোহিত ভেমুলা আত্মহত্যা করেন। প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠেন ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
বলা যায় এরই ধারাবাহিকতায় আসে দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন। কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করলে এবিভিপি সেখানে হামলা করে। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজক ছাত্রদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান দেয়ার অভিযোগ তোলা হয়।

ঘটনা খুব দ্রুত গতিতে অন্যদিকে মোড় নেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ সভাপতি কানহাইয়া কুমারকে। তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ভারতের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিসহ চল্লিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি একাত্মতা ঘোষণা করে। কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসেন বিজেপির নেতারা। শুরু থেকেই তারা এবং তাদের প্রভু বৃহৎ পুঁজির মিডিয়াগুলো আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। গ্রেপ্তার করা ছাত্রনেতাদের রাষ্ট্রদোহী এবং ভারতবিরোধী বলে প্রচার করা হয়। মূল ধারার সব মিডিয়ারই বয়ান ছিল একপাক্ষিক। যা থেকে সত্যিটা জানার সুযোগ ছিল না। অতঃপর ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবে উঠে আসে আসল ঘটনা।
এরকম ঘটনা দেশে-বিদেশে প্রচুর। আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতে করপোরেট মিডিয়া একজোট হয়ে মুহূর্তে রাত কে দিনকে রাত বানাতে পারে। মিডিয়ার ব্যাপক বেসরকারিকরণের ফলে সংবাদ গুরুত্ব হারিয়েছে। জয় জয়কার হয়েছে হাল্কা বিনোদনের। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে জাতীয় উন্নয়ন বিষয়ক অনুষ্ঠান বলতে পাওয়া যায় এ বিষয়ের করপোরেট ভাষ্য। কারণ তাতেই বাণিজ্য তাতেই লাভ। জনস্বার্থের জন্য তাদের কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা নেই। তাদের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা হাল্কা বিনোদন, গ্লামার ও বিজ্ঞাপনের জৌলুসে ভুলিয়ে রেখে মানুষের আসল সমস্যা আড়াল করা।

×