
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশে নারী নিপীড়নের ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা সামাজিক মর্যাদাহানি ও লোকলজ্জার ভয়ে প্রকাশ করেন না। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকায় গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত কল্পে চালু হয়েছে ‘হেল্প’ অ্যাপ। যার পুরো নাম হ্যারাসমেন্ট এলিমিনেশন লিটারেসি প্রোগ্রাম (হেল্প)।
স্মার্টফোন দিয়ে এ অ্যাপ ব্যবহার করে চলন্ত বাস কিংবা যে কোনো স্থানে নারীরা নির্যাতন, হয়রানি বা যৌন নিপীড়নের শিকার হলে তৎক্ষণাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চাইতে পারবেন। পাইলট প্রকল্প হিসেবে শুরুতে এই সেবা ঢাকার বছিলা থেকে সায়েদাবাদ রুটে বাস্তবায়ন করা হবে। যদিও সীমিত আকারে সেবাটি দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে নিতে পারবেন নারীরা।
ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) ও সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন যৌথভাবে চালু করেছে পরিষেবাটি। এটি আমাদের মা-বোনদের সুরক্ষার জন্য একটি মাইল ফলক উদ্যোগ। ডিএমপি কমিশনার বলেছে, এখন থেকে এ অ্যাপের মাধ্যমে পাওয়া সকল অভিযোগ এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করা হবে। এটি সত্যিই অনন্য এক উদ্যোগ।
উন্নত বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়ন, অধিকার, সমতা ও সক্ষমতা থাকলেও বাংলাদেশে সব শ্রেণীর নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার পরিসংখ্যান রীতিমতো গা শিউড়ে ওঠার মতো উদ্বেগজনক। যা নির্মম ও কঠিন সামাজিক বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশে গত (২০২০-২৪) পাঁচ বছরে কমপক্ষে ১১ হাজার ৭৫৮ নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৬ হাজার ৩০৫ জন ধর্ষণের শিকার।
উদ্বেগের বিষয় হলো, যারা ধর্ষিতা হয়েছেন, তাদের ৩ হাজার ৪৭১ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে, যা মোট ঘটনার ৫৫ শতাংশের বেশি। সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে ১ হাজার ৮৯ নারী ও কন্যাশিশুকে এবং যৌন সহিংসতার পর ২০৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১১৮ জনই শিশু। ভয়াবহ সহিংসতার ট্রমা সহ্য করতে না পেরে ৫০ জন আত্মহত্যা করেছেন।
যৌতুকের দাবিতে ৩৫৫ নারীকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। যৌতুক-সম্পর্কিত সহিংসতায় ২৯০ নারীর মৃত্যু হয়েছে। যাদের মধ্যে ২৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। একই সময়ে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনায় ১ হাজার ২৬২ নারী নিহত, ৩৮৬ জন আহত এবং ৪১৬ জন আত্মহত্যা করেছেন।
এসিড হামলায় ৯৪ জন নারী ও কন্যাশিশু আহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৯ জন এই ভয়াবহ হামলায় মারা গেছেন। ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসের পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। অন্তত ২২৪ নারী ও কন্যাশিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ১০৭ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ৬৬ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক।
শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে কুসংস্কার ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যাও করেছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, পুলিশের উদাসীনতা এবং বিচারব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতায় অপরাধীরা শাস্তি এড়ানোর সুযোগ পায়। অনেক সময় শহর কিংবা গ্রামের সমাজপতিরা নারীদের আইনি সহায়তা নিতে বাধা দেয়। যার ফলে আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত হয়।
নারীর প্রতি সহিংসতার পরিধি কেবল ধর্ষণ নয়, বরং বহুমাত্রিক নির্যাতন করা হয়। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা হয় এমন পরিবারেও নারী নির্যাতনের কথা শোনা যায়। যত আইন-কানুনই করা হোক না কেন, কোনো আইনই নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে পারবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত নির্যাতন ও ধর্ষণের উৎসমূলে আঘাত করা হবে। সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং গণমাধ্যমে অশ্লীল নাটক-সিনেমা, টেলিফিল্ম, টিকটক, রিলস প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে।
বন্ধ করে দিতে হবে পর্নো সাইটগুলো। কখনো অপরাধের উৎসমূল বন্ধ না করে নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়। কবি বলেছেন, বিশ্বে যা কিছু সুন্দর চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। নারীর অংশ গ্রহণ ছাড়া কখনো সমাজ-সভ্যতা এগিয়ে নেওয়া যায় না। যদি আমাদের মা-বোন, কন্যারা এগিয়ে যায়, তাহলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আগামী প্রজন্ম। উন্নত ও সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ।