ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৮ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১

নিরুদ্দেশ ঢাকার কাক

হৃদয় পান্ডে

প্রকাশিত: ১৯:৩১, ১৭ মার্চ ২০২৫

নিরুদ্দেশ ঢাকার কাক

ঢাকার সকাল মানেই ছিল কাকের কা-কা ডাকের সরব অভ্যর্থনা। পুরান ঢাকার সরু গলি থেকে শুরু করে নতুন ঢাকার ব্যস্ত সড়ক, লালবাগ কেল্লার প্রাচীন দেয়াল থেকে হাতিরঝিলের জলে প্রতিফলিত আকাশÑ সর্বত্রই ছিল কাকের অবাধ বিচরণ। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা খাবারের টুকরো নিয়ে ঠোকাঠুকি, কিংবা কোনো পুরনো বটগাছের ডালে দল বেঁধে বসে তাদের কলরব ছিল নগরজীবনের অঙ্গ। যেন শহরের আত্মা লুকিয়ে ছিল সেই চিরচেনা ডাকে। কিন্তু আজ? শহরের আকাশজুড়ে সেই পরিচিত ডাক আর তেমন শোনা যায় না। ব্যস্ত নগরের কোলাহলে কাকেরা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। কোথায় গেল তারা? কেনই বা ঢাকার এই চিরপরিচিত পাখিরা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে পড়ছে?
কাককে আমরা অনেকেই অবহেলার চোখে দেখি। কখনো বিরক্ত হয়ে তাড়িয়ে দিই, কখনো আবার তাদের অমঙ্গলের প্রতীক বলে অপবাদ দিই। অথচ এই অবহেলিত পাখিগুলোর অবদান শহরের পরিবেশের জন্য অপরিসীম। কাক হলো প্রকৃতির নিরলস পরিচ্ছন্নকর্মী। রাস্তাঘাটের আবর্জনা, পচা-গলা খাবার, মৃত প্রাণী কিংবা নষ্ট ফল খেয়ে তারা নীরবে শহরকে জীবাণুমুক্ত রাখে। কাকের উপস্থিতি ছাড়া ঢাকার রাস্তায় ময়লার স্তূপ আরও দ্রুত জমত, পরিবেশ দূষণ হতো আরও তীব্র। বলা চলে, নগরের ভারসাম্য রক্ষায় কাক এক অনিবার্য অংশ। তবুও কেন দিন দিন কমে যাচ্ছে এই উপকারী পাখিগুলোর সংখ্যা? উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে নগরায়নের অপ্রতিহত গতি, ক্রমবর্ধমান দূষণ, প্রযুক্তির আগ্রাসন এবং জীববৈচিত্র্যের প্রতি আমাদের দীর্ঘদিনের অবহেলার দিকে।
ঢাকা শহরের উন্নয়নের নামে দিন দিন কংক্রিটের জঙ্গল বাড়ছে। অথচ সবুজের পরিসর ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। একসময় পুরানো ঢাকার বিশাল বটগাছ, পুকুর, আমগাছের ডালে কাকেরা দল বেঁধে বাসা বাঁধত। গাছের ঘন পাতার আড়ালে কাকের ডাক আর ডানা ঝাপটানোর শব্দে মুখরিত হতো সকাল-বিকেল। কিন্তু সেসব গাছের জায়গা এখন দখল নিয়েছে উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট, শপিং মল আর কাঁচের দেওয়ালের ঝলমলে অফিস। যেখানে একসময় কাকেরা নিশ্চিন্তে রাত কাটাত, সেখানে এখন জ্বলে কৃত্রিম আলো, চলে অবিরাম নির্মাণ কাজ। কাকের চেনা আশ্রয় হারিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে শহরের এক টুকরো প্রকৃতি।
ঢাকার আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় সাম্প্রতিক উন্নতি মানুষের জন্য আশার খবর। কিন্তু কাকের জন্য নয়। একসময় রাস্তার ধারে উন্মুক্ত ডাস্টবিনে সহজেই খাবার পেত তারা। পচা ফল, উচ্ছিষ্ট খাবার, কিংবা ছোটখাটো প্রাণীর মৃতদেহ ছিল তাদের সহজলভ্য খাবার। কিন্তু এখন অনেক স্থানে ডাস্টবিন ঢেকে রাখা হয়, ময়লা দ্রুত সংগ্রহ করা হয়। ফলে কাকের খাবারের উৎস সংকুচিত হচ্ছে। ক্ষুধার্ত কাকেরা হয়তো বেঁচে থাকার তাগিদে শহর ছেড়ে অপেক্ষাকৃত শান্ত, গ্রামীণ এলাকায় পাড়ি জমাচ্ছে। ঢাকার বায়ু দূষণ, রাসায়নিক বর্জ্য আর অপরিকল্পিত আবর্জনা ব্যবস্থাপনা কাকের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পচা খাবারের সঙ্গে মিশে থাকা প্লাস্টিক, কীটনাশক বা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ খেয়ে অনেক কাক অসুস্থ হয়ে পড়ে, নিঃশব্দে মারা যায়। পথের ধারে ফেলে দেওয়া বিষাক্ত ফল বা খাদ্য খাওয়ার পর অসহায় পাখিগুলো গাছের ডালে কিংবা রাস্তার পাশে নিথর পড়ে থাকে সেই মৃত্যু যেন কেউ দেখে না, কেউ বোঝে না।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মোবাইল টাওয়ার, ওয়াইফাই, আর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের অদৃশ্য তরঙ্গ পাখিদের আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কাকের মতো বুদ্ধিমান পাখিরা পরিবেশের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। এই তরঙ্গের কারণে তাদের দিকনির্দেশনা ও যোগাযোগের ক্ষমতা ব্যাহত হতে পারে। ফলে তারা নিজেদের বাসা খুঁজে পেতে, এমনকি খাবারের উৎস চিহ্নিত করতেও সমস্যায় পড়ে। কাকের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ মানুষের মানসিক পরিবর্তন। একসময় ছাদে বা উঠোনে চাল-ডাল ছিটিয়ে অনেকেই কাককে খেতে দিতেন, ছোটরা আনন্দ পেত কাকের দল উড়ে আসার দৃশ্যে। এখন সেই অভ্যাস প্রায় হারিয়ে গেছে। অনেকেই কাক দেখলে বিরক্ত হন। তাড়া দিয়ে উড়িয়ে দেন। এমনকি কাকের বাসা ভেঙে ফেলেন। ফলে কাকেরা নিজেদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায় না, শহরকে ক্রমেই অচেনা মনে হয় তাদের।
কাকের হারিয়ে যাওয়া শুধুই একটি পাখির হারিয়ে যাওয়া নয় এটি শহরের জীববৈচিত্র্যের ক্রমাগত সংকটের প্রতীক। কাক প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী, তারা খাদ্যচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শহরের ইকোসিস্টেমের এক অনিবার্য ভারসাম্যহীনতা। কাকের ডাকহীন ঢাকা যেন আরও নিস্তব্ধ, আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। কাকের না থাকা আমাদের চোখে তেমন বড় বিষয় মনে নাও হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতি তার অভাব গভীরভাবে অনুভব করে।

×