
ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে উত্তাল এখন সারাদেশ। বিভিন্ন স্থানে মিছিল-সমাবেশ করে ধর্ষক ও নিপীড়কদের কঠোর শাস্তির দাবি জানানো হচ্ছে। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধন হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৪০১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯ জন। শুধু ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ নারী। এদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। আর ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ শিশু, ১৭ কিশোরী রয়েছেন। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিন কিশোরী ও ১৪ নারী, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে দুই নারী। ইউনিসেফের তথ্যমতে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে প্রতি আটজনে এক নারী ১৮ বছর বয়স হবার আগেই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আসক বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে ৩ হাজার ৪৩৮টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। আর সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে আছে ৯৩৩ জন। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে দেশে অন্তত ছয় হাজার ৩০৫ নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে। এদিকে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে এক হাজার ৮৯ নারী ও শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০৭ জনকে। এর মধ্যে শিশু ১১৮ জন। শিশু ও নারী ধর্ষণের এই চিত্র শুধু ভয়ংকরই নয়, অত্যন্ত লজ্জা ও অপমানকর।
এসব অপরাধ দমনে রাষ্ট্র ও পুলিশ বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও যেন কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় বিদ্যমান আইনের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি তথা মোবাইল অ্যাপস, ইন্টারনেট অব থিংসের (আইওটি) ব্যবহার এক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। কিছু অ্যাপস ইতোমধ্যেই দেশে চালু রয়েছে। এগুলো হলো ‘অ্যান্টি রেপ ডিভাইস’, ‘জয়’, ‘অ্যালী’, বাঁচাও, ‘অঙ্গনা’, হেল্প, ইত্যাদি। ‘অ্যান্টি রেপ ডিভাইস’Ñ একটি ক্ষুদ্র ডিভাইস, তৈরি হয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। হাত ঘড়ি কিংবা আঙুলে রিং হিসেবে পরা যায়, গলায় যে কোনো চেইনের সঙ্গে বা কোমড়ে রাখা যায়। আবার পরিধেয়ও বস্ত্র এবং ব্যাগের ভেতরেও রাখা যায়। যখন ভিকটিম আক্রান্ত হবেন, তখন তিনি বাটন চেপে পুলিশের সহায়তা চাইতে পারবেন। অথবা স্বয়ংক্রিয়ভাবেও পুলিশের কাছে বার্তা চলে যাবে। তখন পুলিশ ডিভাইসটি ট্র্যাকিং করে ভিকটিমকে উদ্ধার করবে। এছাড়া এটি অ্যালার্ম দিতে সক্ষম। ‘জয়’ মোবাইল অ্যাপ এটুআই এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পের উদ্ভাবিত একটি অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার, তৈরি হয়েছে ২০১৮ সালে। গুগল অ্যাপস্টোরে ‘জয় ১০৯’ লিখে সার্চ করে অ্যাপটি ডাউনলোড করা যায়। উক্ত অ্যাপের মাধ্যমে নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতনের জরুরি মুহূর্তে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ সুপার, মেট্রো এলাকার পুলিশ কমিশনার, নির্দিষ্ট ৩টি এফএনএফ নাম্বার এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার (১০৯) এ ঝগঝ আসবে। এছাড়াও নির্যাতন/সহিংসতার মুহূর্তে মোবাইলে নির্দিষ্ট ইমার্জেন্সি বাটন চেপে ভিক্টিমের জিপিএস লোকেশন, ছবি এবং অডিও রেকর্ডিং মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জানানো যায়। লিখিত অভিযোগ পাঠানোর জন্য অ্যাপসটির ‘অভিযোগ করুন’ অপশনে গিয়ে অভিযোগের ধরন বাছাই করে বিবরণসহ অভিযোগ করা যায়। এছাড়াও ‘সংযুক্ত করুন’ অপশনে ছবি এবং অডিও সংযুক্ত করে প্রেরণ করা যায়। ভিকটিমের তাৎক্ষণিক প্রতিকার প্রদান এবং অপরাধী শনাক্ত করার নিমিত্ত বর্ণিত অ্যাপসটি একটি কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে। এদিকে ২০২০ সালের (২৬ জানুয়ারি) এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি আয়োজিত সফটওয়্যার প্রদর্শনীতে ‘অ্যালী’ (অখখণ) নামে একটি অ্যাপস তৈরি করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি দল। ‘অ্যালী’ মানে বন্ধু- বিপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। অ্যাপসটি নারীদের ধর্ষণ রোধ, হ্যারেজম্যান্ট, ছিনতাই প্রতিরোধসহ যে কোনো বিপজ্জনক মুহূর্তে সুরক্ষা দিতে কাজ করে। ব্যবহারকারী কোনো অপরিচিত জায়গা দিয়ে যায় অথবা কোনো বিপদের পড়ার আশঙ্কা করলে অ্যাপটির ‘ড্যানজার মুড’ অন করে রাখতে হবে। পরবর্তীতে কোনো প্রকার ‘শ্যাকিং’ কিংবা হেল্প সাউন্ড শুনলে অ্যাপসটি থেকে অটোমেটিক্যালি তার বিশ্বস্ত নম্বরে কল, ম্যাসেজ ও ই-মেইল (কারেন্ট লোকেশনসহ) চলে যাবে। এ অ্যাপসের মাধ্যমে কাছের পুলিশ অথবা র্যাবের সঙ্গে কানেক্ট হতে পারবে। এছাড়া জরুরি প্রয়োজনে ৯৯৯ এ কল দেওয়া ও অ্যাম্বুলেন্স এবং ব্লাড ডোনার খুঁজতে পারবে। অ্যাপসটি গুগলের প্লে-স্টোরে রক্ষিত আছে।
জানুয়ারি ২০২২ সালে চালু হয় মোবাইল অ্যাপ ‘বাঁচাও’। এই অ্যাপটির সাহায্যে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির হাত থেকে সহজেই রক্ষা পেতে পারেন অনেক নারী। জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে বাঁচাও অ্যাপে। যেখানে একটি মাত্র ছোঁয়ায় সমস্যায় পড়া একজন নারী তার কাছাকাছি স্বেচ্ছাসেবক, পরিবার, বন্ধু অথবা পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। এই অ্যাপটি সহায়তা চাওয়া নারীর অবস্থান নির্দেশ করে এবং এর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে টেক্সট কিংবা অডিওর মাধ্যমে তার যোগাযোগ স্থাপন করে। গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি ইন্সটল করার পর জরুরি যোগাযোগের জন্য পরিবার এবং বন্ধুদের ফোন নম্বর নির্বাচন করতে হয়। যদি কোনো নারী ধর্ষণের আশঙ্কা করেন, তবে তিনি ‘রেপ অ্যালার্ট’ লেখা লাল বোতাম চাপলেই হবে। কাছাকাছি থাকা স্বেচ্ছাসেবকরা ওই সতর্কবার্তা পেয়ে যাবেন এবং তারা ‘মেসেজ’ দিয়ে যোগাযোগ করবেন কিংবা ওই নারীকে সহায়তার জন্য ফোন করবেন। ওই নারীও পাল্টা যোগাযোগ করতে পারবেন। নিজেকে নিরাপদ মনে করলে ওই নারীকে ‘সেফ নাউ’ লেখা সবুজ বোতামে একবার চাপ দিলেই হবে।
‘অঙ্গনা’ এমন একটি মোবাইল অ্যাপ যা কোনো নারী অথবা ব্যক্তি বিপদে থাকাকালীন লোকেশন শেয়ার করতে সক্ষম। কোনো নারী বা ব্যক্তি কখনো অসচেতন অনুভব করলেই সে তার নিকটআত্মীয় ও অ্যাপের অন্য ব্যবহারকারীদের জানাতে পারবে তার বর্তমান অবস্থান। এছাড়া রয়েছে একটি ট্যাগ, যার সাহায্যে ফোনে স্পর্শ করা ছাড়াই নিকটতম সাহায্যকারীকে নোটিফাই করা যাবে। রাজধানীর সরকারি বিজ্ঞান কলেজের তিন শিক্ষার্থী ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অ্যাপটি তৈরি করেন। অতি সম্প্রতি, ১৫ মার্চ ২০২৫, রাজধানীতে গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে চালু হয়েছে ‘হেল্প’ অ্যাপ (হেল্প- (HELP : হ্যারাসমেন্ট এলিমিনেশন লিটারেসি প্রোগ্রাম)। এ অ্যাপের মাধ্যমে স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে চলন্ত বাস বা যে কোনো গণপরিবহনে নারীরা তাদের সঙ্গে ঘটা যে কোনো হয়রানি বা যৌন নিপীড়নের ঘটনার জন্য তৎক্ষণাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা ও অভিযোগ জানাতে পারে। ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) ও সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন যৌথভাবে পরিষেবাটি চালু করেছে। গণপরিবহনে হেল্প অ্যাপে পাওয়া অভিযোগকে প্রাথমিক অভিযোগ বা এফআইআর হিসেবে ধরে পুলিশ কাজ করবে। সে ক্ষেত্রে কাউকে থানায় যেতে হবে না, মেসেজ পাওয়ার পরপরই অ্যাকশন শুরু হবে। এইভাবে আধুনিক ডিজিটাল ডিভাইস, প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের সহায়তায় এ ধরনের আরও অ্যাপস তৈরির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এসব প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগে শিশু ও নারী ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মাত্রা অনেকটা কমে আসবে বলে মনে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়