
‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’Ñ এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কাজের গুণগত ও কারিগরি মান নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ওপর অর্পিত প্রকল্পসমূহ বরাদ্দকৃত বাজেটের মধ্যে এবং প্রাক্কলিত সময়ের আগেই সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয় বিধায় দেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পসমূহে সেনা সদস্যদের সম্পৃক্ততার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিক্ষার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত স্কুল, কলেজ (সাধারণ, চিকিৎসা ও ক্যাডেট) এবং বিশ্ববিদ্যালয় (সাধারণ, কারিগরি ও বিশেষ) প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশকে আলোকিত করতে অবদান রাখছে। বর্তমানে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৪৪টি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ এবং ১৯টি ইংলিশ মিডিয়াম/ ভার্সনসহ সারাদেশে ১২টি ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী ও ক্যাডেটগণ জাতীয় পরীক্ষাসমূহে ঈর্ষণীয় সাফল্যের পাশাপাশি চৌকস ও নেতৃত্বদানে পারদর্শী দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠছে।
উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা ও আধুনিক জ্ঞানচর্চার জন্য মিরপুর সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্। প্রকৌশল শিক্ষার ক্ষেত্র প্রসারিত করার লক্ষ্যে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ও কুমিল্লা, সৈয়দপুর ও কাদিরাবাদ সেনানিবাসে ৩টি আর্মি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পেশায় দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করছে। এছাড়াও ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে শিক্ষা প্রসারে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাভার ও সিলেট সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেনা পরিবার কল্যাণ সমিতির পৃষ্ঠাপোষকতায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের দক্ষ জনশক্তি হিসাবে গড়ে তোলার জন্য দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে ১০টি বিশেষায়িত স্কুল (প্রয়াস) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আইকনিক মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণ চলাকালীন সময়ে সেনাবাহিনী জাজিরা ও মাওয়া এপ্রোচ রোড নির্মাণ, নদীশাসন ও নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি ব্রিজ অ্যান্ড ফ্যাসিলিটিজ সার্ভিস এরিয়ার কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের পরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বর্তমানে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য সুপারভিশন পরামর্শক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে সেনাবাহিনী। পদ্মা রেলওয়ে সেতু বাস্তবায়নের পর দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর উন্নয়নমূলক কাজ, ব্রিজ, ওভারব্রিজ, নদী ড্রেজিং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করা হচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প, চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর মহিপাল ফ্লাইওভার, ঢাকা শহরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মিরপুর এয়ারপোর্ট রোডে ফ্লাইওভার, বনানী লেভেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ, ৩০০ ফিট পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে, ১০০ ফিট খাল খনন প্রকল্প, মেঘনা-গোমতী ব্রিজের মেরামতকার্য, পদ্মা নদী ড্রেজিং প্রকল্প, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নমূলক প্রকল্প এবং জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন সড়ক উন্নয়ন নির্মাণের কাজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করা হচ্ছে। এসবই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক বাস্তবায়ন করা জাতি গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম উদাহরণ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনা সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় বিভিন্ন সড়ক নির্মাণ করার কারণে পাহাড়ি জনপদে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজার অর্থনীতি ও বিপণন সফলতার মুখ দেখেছে, স্বাস্থ্য সেবায় সূচক উন্নত হয়েছে, চাষাবাদ বেড়েছে, জীবনধারায় পরিবর্তন এসেছে এবং কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার কমেছে। সর্বোপরি পার্বত্য তিন জেলায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ে এসেছে উন্নয়ন ও প্রাণের স্পন্দন। বর্তমানে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের দুর্গম সীমান্ত এলাকায় ১০৩৬ কিঃ মিঃ দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক নির্মাণের প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে পার্বত্য জেলাগুলোর সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেগা প্রজেক্টটি হাতে নেওয়া হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ, রক্ষণাবেক্ষণ, পারমাণবিক জ্বালানি পরিবহন এবং প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, যা বাংলাদেশের মানুষের কাছে দেশের সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। সেনাবাহিনী অত্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র তথা ভোটার আইডি কার্ড মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট এবং মেশিন রিডেবল ভিসা তৈরির ব্যাপারে সরকারের গ্রহীত প্রকল্প বাস্তাবয়নের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দেশে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল পরিবহনের প্রকল্পটি চলমান। প্রজেক্টটি সফল হলে জ্বালানি তেলের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণের প্রকল্পটি সেনা সদস্যগণ দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে চট্টগ্রাম নগরবাসী মুক্তি পাবে। উপরোক্ত প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতি গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ দেশের উন্নয়নে অগ্রগামী ভূমিকা রাখারই উদাহরণ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর হতে অদ্যাবধি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, দেশের জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (কেপিআই) নিরাপত্তা প্রদানসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সম্মানিত সেনাবাহিনী প্রধানের দিকনির্দেশনাকে অনুসরণ করে দেশের ৬২টি জেলায় সেনাসদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সর্বক্ষণিক সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
অপারেশন উত্তরণের আওতায় সেনাবাহিনীর সদস্যগণ মোতায়েন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার পাশাপাশি নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থেকে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়তা করছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে পাহাড়ি জনপদ একটি উন্নত জীবনযাত্রার দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী কক্সবাজার জেলায় মিয়ানমার হতে আগত রোহিঙ্গাদের জন্য এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকায় অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, চিকিৎসা সেবাসহ সার্বিক নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করে দেশের ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ মিশনে মাত্র ১৫ জন সেনা পর্যবেক্ষক প্রেরণের মাধ্যমে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা শান্তিরক্ষী পরিবারের সদস্য হন। আন্তর্জাতিক শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যগণ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, কর্মদক্ষতা, মানবিক মনোভাব ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনছেন সম্মান ও মর্যাদা। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সুনামের সঙ্গে কাজ করে শুধু সেসব দেশে শান্তি ফিরিয়েই আনেননি, আর্থ-সামজিক ক্ষেত্রসহ পুনর্বাসন ক্ষেত্রে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, যা বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে অত্যন্ত উজ্জ্বল করেছে। বিশ্বশান্তি রক্ষায় অদ্যাবধি সেনাবাহিনীর ১২৫ জন সদস্য প্রাণ দিয়েছেন।
চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সিএমএইচ ঢাকা সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের (ক্যান্সার সেন্টার, বার্ন ইউনিট, ফার্টিলিটি সেন্টার) ফলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আধুনিক চিকিৎসা সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা সিএমএইচ থেকে বেসামরিক ব্যক্তিদের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও চিকিৎসা শিক্ষার ক্ষেত্র প্রসারিত করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আর্মস ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ (এএফএমসি) ও ৫টি আর্মি মেডিক্যাল কলেজÑ বগুড়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর ও রংপুর সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশে সেবিকাদের ঘাটতির বিষয় বিবেচনায় এনে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা খাতে সুদক্ষ ও মানসম্পন্ন নার্স তৈরির জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৫টি আর্মি নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করার প্রশাসনিক অনুমোদন প্রাপ্ত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে দুটি আর্মি নার্সিং কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্ব বাস্তবতাকে অনুধাবন করে নারী শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ন্যায় চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারী অফিসার এবং পরবর্তীতে নারী সৈনিক নিয়োগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নারীর সামর্থ্য ও যোগ্যতাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা নারীর ক্ষমতায়নে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বর্তমানে সেনাবাহিনীতে নারী অফিসারগণ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করছেন। এ ছাড়াও আর্মি মেডিক্যাল কোরের নারী অফিসারাগণ অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন। এর ফলে একদিকে যেমন নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন, অন্যদিকে তারা তাদের মেধা ও প্রতিভা দিয়ে সামরিক বাহিনীর চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করছেন।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আর্তমানবতার সেবায় বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমি/পাহাড়/ ভবন ধস, মহামারি ইত্যাদি বিভিন্ন দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি রোধকল্পে সেনাবাহিনী যেভাবে আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তা দেশবাসীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিকিৎসকগণ ও বিভিন্ন টহল দল সারা দেশে মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ, লকডাউন নিশ্চিতকরণ, কোয়ারেন্টাইন সুবিধা স্থাপন, কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা পরিচালনা করেছেন।
২০২৪ সালে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জে বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাসদস্যরা আটকেপড়া বন্যাকবলিত মানুষদের উদ্ধারকাজ পরিচালনা, ত্রাণ কার্যক্রম, খাদ্য ও পানি বিতরণ, চিকিৎসা সেবা পরিচালনা, বাঁধ নির্মাণে সহায়তা এবং পুনর্বাসনের মতো মানবিক সহায়তা প্রদান করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০০৭ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালে আইলা ও অতি সম্প্রতি আম্ফানের সময় সেনাবাহিনীর ভূমিকা হয়েছে জনগণের কাছে প্রশংসিত। গত জুন ২০১৭ সালে পাহাড় ধসে পার্বত্য ৩ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সেনাবাহিনী কঠোর পরিশ্রম করে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার অভিযান, পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের খাবার, পানি ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করে জনগণের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করে জাতীয় পরিমণ্ডলে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম অনেক দেশ যেমনÑ মিয়ানমার, চীন, জাপান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, হাইতি, তুরস্ক, মিসর, মালদ্বীপে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত হয়ে দক্ষতার সঙ্গে দুর্যোগ মোকাবিলা করে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রমে পার্বত্য তিন জেলায় যোগাযোগ সুবিধা, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অবকাঠামো নির্মাণ এবং রাতযাপনের সুবিধা তৈরি হওয়ায় সৌন্দর্যপিপাসু হাজারো মানুষ এখন পার্বত্য তিন জেলায় বিভিন্ন দুর্গম স্থানে ভ্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছে। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে নির্মিত নীলগিরি, সাজেক, থানচি, রাঙ্গামাটি ও কাপ্তাই লেকে রিসোর্ট এবং ৮০ কিঃ মিঃ দীর্ঘ অতি গুরুত্বপূর্ণ কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভটি পর্যটনশিল্প বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। রেমাক্রি, বড়পাথর, নাফাখুম জলপ্রপাত, শুভলং জলপ্রপাত, বগা লেক, আলুটিলা, চিম্বুক, স্বর্ণমন্দির প্রভৃতি এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তাবিধানের মাধ্যমে পর্যটন শিল্প অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালীদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে।
জাতীয় পর্যায়ে লোকসানি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) ২০০০ সালে ও বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট লিমিটেড ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের পর কাজের গুণগত ও কারিগরি মান নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যথাযথ তদারকির কারণে সেগুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত সেনা কল্যাণ সংস্থা নির্ভেজাল দ্রব্য বাজারে সরবরাহ করে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে অবদান রাখছে। দরিদ্র ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্বল্প বাজেটের মধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে ব্যারাক নির্মাণ করে সুষ্ঠুভাবে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করায় জাতীয় পরিমণ্ডলে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রায় অবদান রাখার জন্য দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্যগণ বদ্ধপরিকর ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইতোমধ্যেই আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে দেশপ্রেমী সেনাবাহিনীর জন্য আছে দৃঢ় বিশ্বাস, ভরসা আর ভালোবাসা। এ অর্জন সত্যিই অতুলনীয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নের অংশীদার হতে পেরে সেনা সদস্যরা গর্বিত ও আনন্দিত। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা, আমাদের পূর্বসূরীদের মতো জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে আমরা যেন হতে পারি জাতীয় আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক।
লেখক : সেনা কর্মকর্তা