
বাংলাদেশ সমাজের প্রাণবন্ত সংস্কৃতি এবং স্থিতিস্থাপকতার জন্য পরিচিত। তবে বর্তমানে একটি উদ্বেগজনক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে, যা জনগণকে জর্জরিত করে চলেছে- তাহলো শিশুদের ওপর যৌন সহিংসতার ক্রমবর্ধমান ঘটনা। দশক যাবৎ, এটা সামাজিক মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, যা নারী, শিশু, বয়স্ক, এমনকি গর্ভবতী মহিলাসহ অনেক দুর্বল গোষ্ঠীর জীবনকে স্পর্শ করছে। তবে সবচেয়ে বিরক্তিকর প্রবণতার মধ্যে একটি হলো যৌন নির্যাতনের হার বৃদ্ধি, বিশেষ করে খুব কম বয়সী মেয়ে শিশুর ওপর। সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ একটি ভয়ঙ্কর বাস্তবতা প্রতিফলিত করে। ৩ বছর থেকে শুরু করে শিশুরা, বিশেষ করে মেয়েরা প্রায়ই সতর্কতা বা তাদের প্রাপ্য সুরক্ষা ছাড়াই জঘন্য অপরাধের শিকার হচ্ছে।
শিশুদের ওপর যৌন সহিংসতার ব্যাপকতা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এই ঘটনাকে ঘিরে নীরবতা কেবল সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে। সমাজ তার সবচেয়ে দুর্বল সদস্যদের রক্ষা করতে অক্ষম বলে মনে হচ্ছে। এই বিষয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের অভাব বাংলাদেশে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে। সাম্প্রতিক মর্মান্তিক ঘটনাসমূহ এই সমস্যার তীব্রতা তুলে ধরেছে। একটি ঘটনাÑ মাগুরায় আট বছর বয়সী এক মেয়েকে তার বোনের শ্বশুর নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে সাতদিন হাসপাতালে নরক যন্ত্রণা ভোগ করার পর তার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটায়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি সমগ্র জাতিকে হতবাক এবং একটি অসহায় শিশুর সঙ্গে কিভাবে এই ধরনের নৃশংসতা ঘটাতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
উদ্বেগজনক বিষয় হলো, তিন-চার বছর বয়সী শিশুরা ক্রমাগতভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এই ন্যক্কারজনক প্রবণতাটি বিচ্ছিন্ন নয়। কারণ, সারাদেশের গণমাধ্যম বিভিন্ন বয়সের শিশুদের সঙ্গে একই ধরনের ঘটনার রিপোর্ট করেছে, যা প্রকৃত ঘটনার আংশিক চিত্র। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে একটি মর্মান্তিক পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছেÑ মাত্র পাঁচ বছরে দেশে ১২,০০০-এর বেশি নারী ও মেয়ে কোনো না কোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ৬,০০০-এরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ১২ মার্চ, ২০২৫ তারিখে বিশেষভাবে একটি মর্মান্তিক ঘটনার রিপোর্ট করা হয়েছিল, যেখানে তিন বছরের শিশুকে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ৯ মার্চ সিরাজগঞ্জে দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে সকাল বেলায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে আরেক কিশোর ছাত্র। স্থানীয়ভাবে আপোসের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় পরে তা সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করা হয় (বাংলা ট্রিবিউন, ১৪ মার্চ, ২০২৫)। ১১ মার্চ, ২০২৫ তারিখের ডেইলি স্টারের খবর থেকে জানা যায়, একই দিনে ৬ জেলায় ৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
ইউনিসেফের মতে বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যানও একইভাবে হতাশাজনক। বিশ্বব্যাপী ৩৭ কোটি নারী ১৮ বছর বয়সের আগেই যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। যার অর্থ প্রতি আটজন নারীর মধ্যে একজন কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশেও পরিসংখ্যানও একইভাবে উদ্বেগজনক। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে গত আট বছরে কমপক্ষে ৩,৪৩৮ জন শিশু যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৫৩৯ জন শিশু ছয় বছরের কম বয়সী, আর ৯৩৩ জনের বয়স সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে। এই চিত্র বাংলাদেশের অনেক শিশুর মুখোমুখি হওয়া ভয়াবহ বাস্তবতা প্রকাশ করে। এই ধরনের ঘটনাসমূহ বিচ্ছিন্ন নয়। এই ধরনের প্রতিবেদন নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মধ্যে অতি কম বয়সী মেয়ে শিশুদের ঝুঁকি তুলে ধরছে, যারা কি না এখনো কিশোরী কিংবা যুবতী হয়ে ওঠেনি, কিংবা সমাজ ও মানুষকে ঠিকমতো বুঝতে শেখেনি।
সমানভাবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুরা তাদের পরিচিত কিংবা পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী এবং বন্ধুদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ১১ মার্চ, ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত বিবিসির একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে যে, এই অপরাধগুলোর বেশিরভাগই পরিচিত বা নিকট আত্মীয়ের দ্বারাই ঘটে, যা একটি বিরক্তিকর প্রবণতা তুলে ধরে। যেখানে শিশুদের নিরাপত্তার জন্য যাদের ওপর আস্থা রাখা উচিত তারা প্রায়ই তাদের নির্দোষতা লঙ্ঘন করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে যৌন নির্যাতনের ৮৫ শতাংশ ঘটনা ঘনিষ্ঠ পরিবারের সদস্য বা শিশুর পরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত হয়। এই পরিসংখ্যান কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি অসংখ্য শিশু যে মানসিক আঘাত এবং যন্ত্রণার মুখোমুখি হয় তার প্রতিনিধিত্ব করে। যে কারও দ্বারাই যৌন নিপীড়ন চরম দুঃখজনক। নিকটাত্মীয়দের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। কারণ, এটি প্রায়ই সবচেয়ে নিরাপদ এবং বিশ্বস্ত স্থানে ঘটেÑ নিজ বাড়িতে কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে। যেমনটা ঘটেছে মাগুরার মেয়ে শিশুটির ক্ষেত্রে। অভিভাবক এবং পরিবারের সদস্যরা যাদের শিশুদের রক্ষা করার কথা তারাই সেই সহিংসতার অপরাধী হয়ে ওঠে, যা থেকে ছোটদের রক্ষা করা উচিত। এই বিশ্বাসভঙ্গ সমাজে শিশুর যৌন নির্যাতনের বিষয়টি কতটা গভীরে প্রোথিত তার একটি বেদনাদায়ক স্মারক। যেখানে অপরাধীরা প্রায়ই পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশী। চারপাশের নিষ্পাপ এবং বিপদ সম্পর্কে অজ্ঞ শিশুরা এই শিকারিদের দ্বারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ে।
শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, এই সমস্যা সম্পর্কে যথাযথ সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব এবং অবহেলা। অনেক মানুষ এখনো সমস্যার গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত নয় এবং সমস্যাটির বিস্তৃতি স্বীকার করতে সাধারণভাবে অনীহা রয়েছে। অনেক সম্প্রদায়ে শিশুর যৌন নির্যাতনকে এখনো একটি নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে দেখা হয়, যা খোলামেলা আলোচনাকে নিরুৎসাহিত করে এবং সমস্যাটি কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার প্রচেষ্টাকে করে বাধাগ্রস্ত। অধিকন্তু শিশুদের যৌন নির্যাতন মোকাবিলায় শক্তিশালী আইনি কাঠামো এবং প্রয়োগের লক্ষণীয় অভাব রয়েছে। শিশুদের নির্যাতন থেকে রক্ষা করার জন্য আইন থাকলেও এই আইনসমূহ প্রায়ই সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় না এবং অনেক অপরাধী শাস্তি থেকে মুক্ত থাকে। ফলস্বরূপ নির্যাতনের চক্র অব্যাহত থাকে এবং ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বর প্রায়ই নীরব হয়ে যায়।
এই সংকট কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য সমস্যাটির পেছনের কারণসমূহ বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যৌন নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান ঘটনার একটি প্রধান কারণ হলো সমাজে সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণ। প্রধানত নারী ও শিশুদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার অভাবে সমাজে যৌন সহিংসতা দেখা দিচ্ছে।
নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য গভীরভাবে প্রোথিত লিঙ্গীয় রীতিনীতি এবং পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করাও প্রয়োজন। লিঙ্গীয় ভূমিকা এবং সহিংসতার চারপাশে সাংস্কৃতিক আখ্যান পরিবর্তন করে, সমাজ শিশুর যৌন নির্যাতনের মূল কারণ চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করতে পারে এবং শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
শিশুর সুরক্ষায় পিতামাতাকে বিশেষ সতর্ক ও যত্নশীল হতে হবে। এই বিশ্বাসভঙ্গ সমাজে গড়ে সবাইকে সন্দেহের চোখে রাখা একটু অস্বস্তিকর মনে হলেও সমাজ বাস্তবতার কারণে সবরকমের সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে বৈকি! প্রাপ্তবয়স্ক নারীর মতো শিশুর বিষয়েও আত্মীয়স্বজন ও আশপাশের ছেলে-পুরুষদের বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে, যতদিন না এই সমাজে স্বাভাবিক মানবিক সম্পর্ক ও বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে শিশুরা নিশ্চিতভাবে তাদের প্রকৃত আত্মীয় বা নিকটজনের আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থায় এই বাড়তি নজরদারি অপরিহার্য।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের জন্য অপর্যাপ্ত সহায়তা ব্যবস্থা। যৌন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা প্রায়ই সামাজিক কলঙ্কের সম্মুখীন হন, যা তাদের সাহায্য চাইতে বাধা দেয়। এই কলঙ্ক কাউন্সেলিং, আইনি সহায়তা এবং চিকিৎসার জন্য অ্যাক্সেসযোগ্য সম্পদের অভাবের কারণে আরও জটিল হয়। সঠিক সহায়তা ছাড়া ভুক্তভোগীদের একা নির্যাতনের ট্রমা মোকাবিলা করতে হয়। যার ফলে তাদের পুনরুদ্ধার এবং জীবন পুনর্নির্মাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর ধর্ষক যদি প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, তাদের সমর্থক বা ধনী হয়, সেক্ষেত্রে বিচারের আশা ভঙ্গ হওয়ার সাম্প্রতিক উদাহরণ আমাদের সবার জানা।
যৌন সহিংসতা এবং শিশু নির্যাতন সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণা গঠনে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু মিডিয়া ও সংস্থা শিশু যৌন নির্যাতন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যরা সমাধান বা পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন না করেই এই বিষয়গুলোকে চাঞ্চল্যকর করে তোলে। এই সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য গণমাধ্যমকে তাদের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে এবং বৃহত্তর সচেতনতা ও নীতি পরিবর্তনের জন্য অ্যাডভোকেসি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে কাজ করতে হবে।
শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা মোকাবিলায় একটি ব্যাপক ও বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা খুব জরুরি। এই পদ্ধতিতে সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষার উন্নতি, আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণ, ভুক্তভোগীদের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান এবং ক্ষতিকারক সামাজিক রীতিনীতিকে চ্যালেঞ্জ করাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিশুদের ওপর যৌন সহিংসতা বন্ধে একটি ব্যাপক জাতীয় প্রচারণা চালাতে হবে। যা বিষয়টিকে জনসাধারণের আলোচনার সামনে তুলে ধরার একটি উপায়। এই প্রচারণায় অভিভাবক, শিক্ষক এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা নির্যাতনের লক্ষণ এবং নির্যাতন প্রতিরোধে তারা কী ভূমিকা পালন করতে পারেন, সে সম্পর্কে শিক্ষিত করার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত। স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় যৌনশিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত, যা শিশুদের অধিকার, কিভাবে নিজেদের রক্ষা করতে হবে এবং নির্যাতনের শিকার হলে কিভাবে সাহায্য চাইতে হবে সে সম্পর্কে শিক্ষা দেবে।
পরিশেষে বাংলাদেশে শিশুদের নিরাপত্তা গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং যৌন সহিংসতার মহামারি রোধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। শিশু এবং কিশোরী মেয়েদের ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যাসহ ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মামলা এই বিষয়টির গুরুত্বের কথা স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশ যদি তার শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ এবং লালন-পালনের পরিবেশ প্রদান করতে চায় তাহলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সরকারি নীতি উভয়ক্ষেত্রেই আমূল পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। নারী-শিশুসহ সকল যৌন নির্যাতনের ভয়াবহতা সম্পর্কে জাতির জেগে ওঠার এবং তার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই চূড়ান্ত সময়।
লেখক : অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়