
ব্রেইন ড্রেইন বা মেধা পাচার বলতে উচ্চ দক্ষ বা শিক্ষিত ব্যক্তিদের এক দেশ বা অঞ্চল থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর করাকে বোঝায়। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে মেধা পাচারের হার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশে উচ্চশিক্ষা বাবদ গত তিন অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেনের পরিমাণ ১৩০ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে লেনদেন হয় ৪১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। পরের অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ কোটি ৯৯ লাখ ডলারে। চলতি অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঠানো হয়েছে ৩৭ কোটি ৩ লাখ ডলার।
২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। এই সংখ্যা ১৭ হাজার ৯৯ জনে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি। গত ২৫ বছরের মধ্যে এটি দ্রুত বৃদ্ধির ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ায় অধ্যয়নরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯ হাজার ৬৮৩ জন। যা ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ৭৪ শতাংশ বেশি।
ওপেন ডোরস ডেটা সূত্রে জানা যায় ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৩,০০০ ছাড়িয়েছে। উপরিউক্ত পরিসংখ্যান নির্দেশ করে যে, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশী উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ভালো সুযোগ সুবিধা, চাকরির ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা,শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মেধার অবমূল্যায়ন, চাকরি ক্ষেত্রে দুর্নীতি, প্রশ্ন ফাঁস বৃদ্ধি, গবেষণার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণে মেধাবী তরুণ প্রজন্মের দেশ ছাড়ার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মেধাপাচার রোধ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় উল্লেখ করা হলো :
১. মেধার সঠিক মূল্যায়ন :
* মেধাবী ব্যক্তিদের জন্য যথাযথ সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে।
* তাদের কাজের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
* গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
২. শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন :
* শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা দেশেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয়।
* গবেষণার সুযোগ বাড়াতে হবে এবং গবেষণার জন্য আধুনিক সরঞ্জাম ও সুবিধা সরবরাহ করতে হবে।
* মেধাবী শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি :
* মেধাবী ব্যক্তিদের জন্য উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
* স্টার্টআপ এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে হবে।
* তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ এবং অন্যান্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
৪. সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা :
* দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে হবে।
* আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং দুর্নীতি রোধ করতে হবে।
* সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মেধাবী ব্যক্তিরা দেশে নিরাপদ বোধ করেন।
৫. সুযোগের সমতা :
* সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মেধাবী ব্যক্তিরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারেন।
* বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে।
* নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. দেশপ্রেম জাগ্রত করা :
* তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে।
* তাদের দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
* সফল ব্যক্তিদের উদাহরণ তুলে ধরতে হবে, যারা দেশে থেকেই সফল হয়েছেন।
৭. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা :
* অন্যান্য দেশের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
* মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক বিনিময় কর্মসূচির আয়োজন করতে হবে।
* বিদেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরে আসার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
৮. সচেতনতা বৃদ্ধি :
* মেধা পাচারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে।
* গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই বিষয়ে প্রচারণা চালাতে হবে।
* শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধা পাচার রোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
এই পদক্ষেপগুলো সম্মিলিতভাবে গ্রহণ করলে মেধা পাচার রোধ করা সম্ভব।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়