ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১

স্বাস্থ্যসেবার বাণিজ্যিকীকরণ

চিকিৎসা কি কেবল বিত্তবানদের জন্য

মোছা. রোকেয়া সুলতানা

প্রকাশিত: ১৯:৩৬, ১৬ মার্চ ২০২৫

চিকিৎসা কি কেবল বিত্তবানদের জন্য

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার বাণিজ্যিকীকরণ বর্তমানে এক উদ্বেগজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে চিকিৎসা সেবা একটি মৌলিক মানবাধিকার হওয়ার কথা, সেখানে তা এখন এক ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হয়েছে, যা কেবল বিত্তবানদের জন্য সহজলভ্য। সরকারের অপর্যাপ্ত উদ্যোগ, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অস্বাভাবিক খরচ, ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিÑ সবই এই সংকটকে তীব্র করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ‘চিকিৎসা কি কেবল বিত্তবানদের জন্য সংরক্ষিত?’
সরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণ মানুষের জন্য মৌলিক সেবা পাওয়া এক চ্যালেঞ্জ। রোগী ভর্তি করতে গেলে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চিকিৎসক বা নার্সের অভাব সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় মোট জিডিপির মাত্র ০.৯%। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। এটি সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো এবং সেবার মানে ঘাটতি সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের প্রতি ৩,০০০ জনের জন্য ১টি হাসপাতাল বেড বরাদ্দ থাকে, যা প্রমাণ করে যে, দেশের স্বাস্থ্য সেবা কার্যত অপ্রতুল।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে অবস্থা আরও খারাপ। এখানে চিকিৎসা সেবা যে একটি বিলাসিতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, তা কোনোভাবে অস্বীকার করা যায় না। শুধু ভর্তি হতে, পরীক্ষা করাতে কিংবা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিতে মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয়। স্বাস্থ্য সেবা এখন আর সাধারণ মানুষের জন্য নয়, তা কেবল বিত্তবানদের এক এক্সক্লুসিভ সুবিধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার জন্য অনেকেই বিদেশে যাওয়ার জন্য পিপাসু হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা এখন এতটাই তীব্র যে, প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়, যার গড় ব্যয় প্রায় ৫,০০০ ডলার বা প্রায় ৫,৫৫,০০০ টাকা।
অন্যদিকে, ওষুধের দাম বেড়েই চলেছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, মানুষের আয় বৃদ্ধির ফলে জটিল রোগের পরিমাণ বেড়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল চিকিৎসার চাহিদা বাড়াচ্ছে। তদুপরি, চিকিৎসা খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা আরও এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালের তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে ৩০% বাজেট অপচয় হয়েছে, যার অধিকাংশই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে।
এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের জন্য সাশ্রয়ী এবং মানসম্মত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রোগীদের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার প্রতিদিন কমে যাচ্ছে। তারা ক্রমশ তাদের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তবে একদিন চিকিৎসা সেবা শুধু ধনীদের জন্যই সংরক্ষিত থাকবে এবং সাধারণ মানুষের জন্য তা এক দুর্লভ সোনালি স্বপ্ন হয়ে উঠবে।
সুতরাং, প্রশ্ন উঠে স্বাস্থ্যসেবা কি শুধু বিত্তবানদের জন্য? যদি চিকিৎসা সেবা একটি মৌলিক মানবাধিকার হয়, তবে তা সবার জন্য সহজলভ্য হওয়া উচিত। সরকারকে তাই শক্ত হাতে স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার ও উন্নয়ন করতে হবে, যাতে সবার জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত হয়। জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বাণিজ্যিকীকরণের অশুভ চক্র ভাঙা সম্ভব হয়।

শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ

×