
ছবি: সংগৃহীত
সমতা এবং ন্যায়বিচারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, যা মূলত তাদের উদ্দেশ্য, ব্যবহৃত দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রয়োগের প্রক্রিয়ায় স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। যদিও এই দুটি ধারণা অনেক সময় একে অপরের সাথে সংযুক্ত হয়, তবুও তাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এখানে সমতা এবং ন্যায়বিচারের মধ্যে পার্থক্য বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
১. সমতা (Equality):
সমতা মানে হল, সকল ব্যক্তির প্রতি সমান আচরণ করা। এটি একটি সমাজে বা পরিস্থিতিতে সব মানুষকে একই সুযোগ, অধিকার এবং প্রাপ্তির অধিকারী করা। সমতার মূল উদ্দেশ্য হল যে, কোন ভেদাভেদ বা বৈষম্য না রেখে, সবাইকে এক রকম সুযোগ বা অধিকার দেওয়া। সমতার মধ্যে প্রতিটি ব্যক্তির জন্য একই আইন এবং নিয়ম প্রযোজ্য হয়।
সকলকে একই সুযোগ দেয়া হয়, যেমন শিক্ষার ক্ষেত্রে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, আইনি সুরক্ষার ক্ষেত্রে। একে অপরের মধ্যে কোনো পার্থক্য না রেখে, এক ধরনের আচরণ বা নীতি প্রয়োগ করা হয়। সাধারণভাবে সমতা আইনের ক্ষেত্রে, সকলের জন্য এক রকম সুযোগ এবং অধিকার নিশ্চিত করা। যদি দুটি ভিন্ন জাতির মানুষকে একসাথে নির্বাচন বা ভোটদান সুযোগ দেয়া হয়, তা হলে এটি সমতা হবে, কারণ সবাইকে একই সুযোগ দেয়া হয়েছে।
২. ন্যায়বিচার (Justice/Fairness):
ন্যায়বিচার মূলত এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে প্রেক্ষাপট, ব্যক্তির অবস্থান এবং পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সঠিক ও সুবিচারমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ন্যায়বিচারে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকা উচিত হলেও, এটি অনেক সময় ব্যক্তির বিশেষ পরিস্থিতি বা প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। এটি শুধু আইনের শাসনকেই নয়, বরং মানবিক, নৈতিক এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দেয়। এটি শুধুমাত্র সমান সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে নয়, বরং প্রতিটি ব্যক্তির বিশেষ অবস্থান এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়। ন্যায়ের ক্ষেত্রে, যদি কোনো এক ব্যক্তি অন্যদের থেকে বেশি সহায়তা বা সুযোগের প্রয়োজন হয়, তাহলে তাকে তেমনটি দেওয়া হয়, যাতে তাকে সমানভাবে সুযোগ পাওয়ার মতো শর্তে পৌঁছানো যায়। এটি বিশেষত মানুষের অবস্থা, প্রেক্ষাপট, এবং নৈতিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে। দুটি ছাত্র যদি একে অপরের সাথে একই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, তবে একজনের যদি শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা থাকে, তবে তাকে বিশেষ সহায়তা প্রদান করা হলে তা ন্যায়বিচার হবে। অর্থাৎ, ন্যায়বিচার একটি ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য বা পরিস্থিতির প্রতি মনোযোগ দেয় এবং তাকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা করে।
সমতা এবং ন্যায়বিচারের মধ্যে পার্থক্য:
সমতা মূলত সমাজে সবার জন্য একরকম অধিকার এবং সুযোগ প্রদান করতে চায়। এটি এমন একটি ধারণা যেখানে সকলের জন্য সবার অধিকার এবং সুযোগ এক রকম থাকবে, যার ফলে কোনো প্রকার বৈষম্য থাকবে না। ন্যায়বিচারের ধারণা এমন, যেখানে বিচার প্রক্রিয়া এবং ফলাফল শুধু আইনের শাসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি নির্ধারণ করা হয় মানুষের বিশেষ পরিস্থিতি, তাদের প্রয়োজন এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী। এটি কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রয়োজন বা অবস্থা অনুযায়ী সুবিচার প্রদান করতে চায়।
সমতা সব ব্যক্তিকে একেবারে একইভাবে দেখতে চায়। অর্থাৎ, সকলের জন্য একই ধরনের সুযোগ ও অধিকার প্রদান করা হবে, তাদের ব্যক্তিগত বা সামাজিক অবস্থান। ন্যায়বিচার তার দৃষ্টিভঙ্গিতে আরও নমনীয় হয় এবং এর মধ্যে প্রতিটি ব্যক্তির বিশেষ অবস্থান এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হয়। এটি লক্ষ্য করে যে, যেসব ব্যক্তির বিশেষ সাহায্য বা সুযোগের প্রয়োজন, তাদের সে অনুযায়ী সহায়তা দেওয়া উচিত।
এটি আইনি এবং সামাজিক ক্ষেত্রের মধ্যে সমান শর্তে বা সুযোগে পৌঁছানোর দিকে নজর দেয়। সমতার মাধ্যমে সবার জন্য একই প্রকার অধিকার নিশ্চিত করা হয়, তবে এটি কখনও কখনও বাস্তব পরিস্থিতির প্রতি উপযুক্ত নয়। এটি আরো ব্যক্তিগত এবং পরিস্থিতি ভিত্তিক। ন্যায়বিচারে, বিভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির কারণে তাদের ন্যায্য অধিকার এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এটি নিশ্চিত করতে চায় যে, প্রতিটি ব্যক্তির সুবিচার সঠিকভাবে হচ্ছে।
সমতার উদ্দেশ্য হলো, সমাজে সবার জন্য একই ধরনের সুযোগ এবং অধিকার প্রদান করা। এটি সাধারণভাবে মনে করে যে, সকল মানুষের উচিত একই ধরনের সুযোগ পাওয়া, যাতে তারা সমানভাবে নিজেদের জীবনধারা গড়ে তুলতে পারে। ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্য হলো, মানুষের অবস্থা, পরিস্থিতি এবং প্রয়োজন অনুসারে সুবিচার নিশ্চিত করা। এটি বুঝতে চায় যে, কেউ যদি অন্যের চেয়ে সুবিধাবঞ্চিত থাকে বা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়, তাহলে তাকে সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী সহায়তা বা সুবিধা দেওয়া উচিত।
সমতা একটি আনুষ্ঠানিক সমান সুযোগ প্রদান করার প্রক্রিয়া, যেখানে সকলকে একইভাবে দেখা হয়। অন্যদিকে, ন্যায়বিচার হলো পরিস্থিতি, প্রয়োজন এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সুবিচার প্রদান করার প্রক্রিয়া। সমতা সবার জন্য একসাথে শর্তাবলী সৃষ্টি করতে চায়, কিন্তু ন্যায়বিচার সেই শর্তগুলির মধ্যে ভিন্নতা গ্রহণ করে এবং সবার জন্য সুবিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। যদিও সমতা এবং ন্যায়বিচারের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে, তবে এগুলোর উদ্দেশ্য প্রায় একটাই: সমাজে সবার জন্য সুবিচার নিশ্চিত করা। তবে, ন্যায়বিচার মাঝে মাঝে শর্তাধীন, যেখানে সমতা সর্বদা সবার জন্য একইরকম অধিকার দিতে চায়।
ফারুক