
রাজশাহী জেলার তৎকালীন নাটোর মহকুমার বাসুদেবপুর ইউনিয়নের বিপ্রবেলঘরিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদ একাত্তর সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লাহোর ফ্রট ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন। তাকে বদলি করা হয় পূর্ব পাকিস্তানের রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ৩৩ এমসি ব্যাটালিয়নে। ২ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে পরিবার নিয়ে অন্যদের সঙ্গে ছাফিনা আরব জাহাজে আসার সময় ৬ মার্চ কলম্বো বন্দরে জাহাজটি তেল নেওয়ার জন্য থামলে পরের দিন ৭ মার্চ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে শুনতে পেলেন ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার পক্ষে দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জাহাজটিতে থাকা অফিসারসহ সৈনিকদের আশিভাগই ছিলেন স্বাধীনতাকামী বাঙালি। এ জাহাজে ছিলেন মেজর আবদুল লতিফ খান, লেফটেন্যান্ট রফিক, লেফটেন্যান্ট হারিছ, লেফটেন্যান্ট গোলাম মুক্তাদিরসহ অনেকেই। বিশেষ বার্তায় তখনই তাদের পশ্চিম পাকিস্তান ফেরার নির্দেশ দেওয়া হলে বাঙালি অফিসার ও সৈনিকেরা। বিদ্রোহ ঘোষণা করে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়ার জন্য মেজর আবদুল লতিফ খানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
১৭ মার্চ জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পৌঁছালে অসহযোগ আন্দোলনকারীরা জাহাজে বাঙালিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র-গোলাবারুদ আনা হয়েছে অভিযোগ দিয়ে জাহাজটি বন্দরে আসতে বাধা দিয়ে পাহারা দিতে থাকে। কিছু সৈনিক জেলেদের নৌকা করে চলে যায়। আবুল কালাম আজাদ ও কয়েকজন পরিবার নিয়ে জাহাজের মধ্যেই অবস্থান করেন। ২২ মার্চ রাত তিনটার দিকে জাহাজের কাছে ট্রলার এলে মেজর লতিফ খান খালি হাতে সাধারণ পোশাকে সকলকে পরিবার নিয়ে ট্রলারটিতে নামতে বলেন। চট্টগ্রাম বন্দর ট্রানজিট ক্যাম্পে পৌঁছানোর পরের দিন সকালে মেজর আবদুল লতিফ খান সাদা কাগজে সই করে এক সপ্তায় ছুটি মঞ্জুর করে সকলকে বিদায় দেন। আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদ পরের দিন ২৩ মার্চ চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে বগুড়া সান্তাহারগামী ট্রেনে ওঠেন। তিনি দেখেন, বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে অসহাযোগ আন্দোলনকারীদের ট্রেনে তল্লাশি চালাচ্ছে।
২৫ মার্চ দুপুরে সান্তাহারে পৌঁছে তিনি তার পরিবারকে নওগাঁয় রেখে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে না গিয়ে দেখা করেন নওগাঁ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) ৭নং উইং হেড কোয়ার্টারের বাঙালি মেজর নাজমুল হকের সঙ্গে। তাকে জানান স্বাধীনতার পক্ষে তার অবস্থানের কথা। মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে কিছু বাঙালি ইপিআর ছাত্র তরুণ যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করা শুরু করেন। ট্রেনিং নেওয়া তরুণ-যুবকদের সঙ্গে নিয়ে অ্যাকশন করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্মস স্টোর রুমে। সংগ্রহ করে নেন কিছু অস্ত্র। নিহত হয় বেশকিছু পাকিস্তানি সেনা। বাকিরা আত্মসমর্পণ করে। গড়ে তোলেন প্রতিরোধ।
১৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে আসা পাকিস্তানি সৈন্যরা নাটোর-নওগাঁ অঞ্চল দখল করে নিলে আবুল কালাম আজাদ একটি ট্রাকে স্কুল-কলেজের কয়েকজন ছাত্র-তরুণ যুবকদের নিয়ে বিকেলে জলঘর সীমান্ত দিয়ে পৌঁছান ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাটে। সেখানে কংগ্রেস অফিসে দেখা গেলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নওগাঁর রাজনৈতিক বাক্তিত্ব এমএ জলিলের। তিনি তাকে নির্দেশ দেন সীমান্তের ওপারে শিববাটি প্রাইমারি স্কুলে দায়িত্ব পালনের। নির্দেশ দিলেন, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগার তরুণ যুবকরা স্লিপ নিয়ে তার কাছে গেলে তিনি যেন তাদের দোতলায় থাকার ব্যবস্থা করেন। নিচে থাকবে বগুড়া জয়পুরহাট হিলি অঞ্চল থেকে যাওয়া তরুণ-যুবক ও অন্যারা। কড়া নির্দেশ দিলেন দোতলা থেকে কেউ যেন নিচে না নামে। কেউ আইন অমান্য করলে যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী শাস্তি দেওয়ার জন্য। এও জানান, বালুরঘাট ক্যাম্প থেকে এ ক্যাম্পে খাদ্যসামগ্রী পাঠানো হবে। শেষ রাতের দিকে কয়েকজন স্কুলটির নিচতলায় বগুড়া ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে নিয়ে যাওয়া টাকাগুলো মেঝেতে ঢেলে দিতে থাকলে আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদ খবরটি বালুরঘাটে পৌঁছে দেন। শেখানে সতর্কতা জারি করা হয়। এ ক্যাম্পে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বালুমাটি থেকে বারোমাইল দূরে বাঙালিপুর প্রাইমারি স্কুলে আরও একটি ক্যাম্প খুলে আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কামারপাড়ায় ৭ নং সেক্টরের ছেড কোয়ার্টার স্থাপন করে মেজর নাজমুল হক ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে তার টুআইডি করে আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদকে ট্রেনিং সুপারভাইজারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হলো পতিরাম ইয়ুথ ক্যাম্পে। মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন এসএস সিরোহীর তাঁবুতে আবদুল জলিল তাকে ডেকে পাঠিয়ে অনুরোধ করলেন সীমান্তের এপারে থাকা তার বাবা ফয়েজ মিয়াকে ভারতে নিয়ে যেতে। খরচের টাকা ঠিকানা ও চিঠি লিখে দেওয়ার পর আবুল কালাম আজাদ অস্ত্র ও নক্সা নিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বালুরঘাট পৌঁছালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুও তাকে অনুরোধ করল তার স্ত্রী ছেলেমেয়েদের ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পাকিস্তানি সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুদিন পর আবুল কালাম আজাদ উত্তর গ্রামের চেয়ারমানের বাড়িতে দেখা পেলেন জাকারিয়া পিন্টুর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের। রামপুরে দাদার বাড়িতে দেখা পেলেন মা বাবা চাচা-চাচিসহ অন্যদের। শেল্টার নেন এ বাড়ির মুরগির খামারে। আবদুল জলিলের চিঠি ও দেওয়া ঠিকানা নিয়ে বড় ভাই আবদুল খালেক ও দুলাভাই সোলেমান আলী মোল্লার সঙ্গে দীঘলি বিলের বোয়ালি গ্রামে দেখা পেলেন আবদুল জলিলের বাবা ফয়েজ মিঞা ও চাচাতো ভাই হারুনের। আবুল কালাম মোহাম্মদ আজাদের সঙ্গে কথা বলে তারা মহিষের গাড়ি করে তাকে তাদের কাছে নিয়ে আসেন। এরপর এক সঙ্গে নওগাঁর নিয়ামতপুরের থানার শীসোলের সোনপুর গ্রামে গিয়ে আবুল কালাম আজাদ দেখা পেলেন স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের। তাদেরও সঙ্গে নিয়ে গেলেন জাকারিয়া পিন্টুর স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের কাছে। দুইশত টাকায় এক সাহায্যকারীর মাধ্যমে মধ্যরাতে পৌঁছালেন ঠসা হাজির বাড়িতে। তার সহযোগিতায় পরের দিন সন্ধ্যায় ১০০ টাকায় এক সাহায্যকারীর সাহায্যে বিলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ডাকাতরা হামলা করলে তিনি গ্রেনেড ও স্টেনগান ব্যবহার করলে ডাকাতরা পালিয়ে যায়। পরের দিন সকাল ৯টায় রাজা হরিশচন্দ্রপুর মন্দিরে কিছু খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেল ৫টার দিকে বালুরঘাটে পৌঁছে আবদুল জলিল ও জাকারিয়া পিন্টুর সঙ্গে দেখা করে শেষ করেন তাকে দেওয়া দায়িত্ব।
স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের পতিরামপুরের চেয়ারম্যান পরেশ উল্লার বাড়িতে রেখে টিএস হিসেবে যোগ দেন পতিরামপুর ক্যাম্পে। ১৪ আগস্ট রাত ৩টায় কমান্ডার নওগার শফিক খান, কমান্ডার রাজা কবিরাজ, আলমগীর কবীর, নাটোরের হাসানুজ্জামান ভুলু, তাহের, ফারুক, কার্তিকসহ অন্যদের নিয়ে বাগমারা থানায় অ্যাকশন করে বারোটি রাইফেল সংগ্রহ করেন। অংশ নিতে থাকেন বিভিন্ন অ্যাকশন অপারেশনে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানি সৈন্যরা নওগাঁর ধানকুড়িতে তার চাচার শ্বশুর বাড়িতে চল্লিশ জনকে হত্যা করে।
লেখক : সাংবাদিক