ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:১৯, ১৫ মার্চ ২০২৫

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন

সড়ক মানে যেন মৃত্যুর মিছিল। এই মৃত্যুর মিছিল নিয়ে জাতি খুবই উদ্বিগ্ন। সড়ক দুর্ঘটনা এখন প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর ঈদ,পূজাসহ অন্যান্য সামাজিক উৎসব আসলে সড়কে প্রাণহানির সংখ্যা অনেকগুণ বেড়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জীবনে যেন এক আতঙ্ক। নিরাপদ সড়ক আমরা সবাই চাচ্ছি। কিন্তু পরিবহনের সাথে যারা জড়িত তারা চাচ্ছে কিনা সন্দেহ আছে। যদি চাইত তাহলে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা এত বৃদ্ধি পেত না। ঘর থেকে বের হলে আর ফিরব কিনা সন্দেহ থাকে। প্রতি বছর জাতীয় নিরাপদ সড়ক নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা করে থাকি আমরা। কিন্তু এ আলোচনার পেছনে যেসব কারণ ছিল,অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না। কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর হাজার হাজার লোক নিহত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার খবর প্রতিদিন আমাদের বেদনাহত করে। সড়ক দুর্ঘটনা একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর কি কোনো সমাধান হবে না আমাদের দেশে?
ঢাকায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে সব রুট বিলুপ্ত করে ৯ রুটে ৯ রঙের উন্নত বাস পরিষেবা চালুর নির্দেশনা দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। যা ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে এই নির্দেশনার অপব্যবহার করে নতুন ও উন্নত বাসের বদলে ফিটনেসবিহীন পুরনো লক্কড়ঝক্কড় বাস রাতারাতি গোলাপি রং করে পরিবহন ব্যবসা করে যাচ্ছে। যা মনিটরিং দরকার। তদারকি না করলে রাজধানীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সড়ক নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনা রোধে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, শত শত সুপারিশ, টাস্কফোর্স–কিছুই তেমন কাজে আসছে না।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৫০১ সড়ক দুর্ঘটনায়  ৪৮২ জন নিহত হয় এবং আহত হয় ৭১৮ জন। তবে ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো দুর্ঘটনা এবং হতাহতের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বিআরটিএ এ বছর। ওই বছর ৫ হাজার ৪৯৫ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ২৪ জন। যদিও বেসরকারি সংগঠনগুলোর চেয়ে সরকারি পরিসংখ্যানে হতাহতের সংখ্যা কম। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) এর তথ্য অনুযায়ী,বাংলাদেশে বছরে ৩১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় দুর্ঘটনায়। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এসব চিত্র দেখলে সড়কে চলাচল ভয়াবহ মনে হয় এবং আমাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এখন ঘর থেকে বের হলে মনে হয় আর সুস্থ জীবনে ফেরত আসব না হয়তো। ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে ১ হাজার ১২ সড়ক দুর্ঘটনায়  ৯৬৩ জন নিহত হয়। কয়েক বছরের হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিদিন প্রায় হাজারের মতো লোক নিহত হয়। কিন্তু এই সংখ্যা বিভিন্ন উৎসবে অনেক বেড়ে যায়।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক ও ক্ষত সৃষ্টি করে না, বরং আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে দেয় ঐ পরিবারকে। যার ক্ষতি কোনদিন পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ, এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার মতো নয়। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয়। ফলে ঐ পরিবারের যে কি করুণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তা বলে শেষ করা যাবে না। আর যারা পঙ্গু হয়ে যায় তাদের পরিবারকে আজীবন তার ভার বহন করে চলতে হয়। গণমাধ্যমে জানতে পারি,সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে গড়ে বাংলাদেশে জিডিপির ক্ষতি হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো গবেষক নেই, গবেষণা নেই, কোনো বাজেট বরাদ্দও নেই। ফলে প্রতি বছর সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েই চলছে। তাই এই বিষয়ে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরি।  
সড়কে ফিটনেসবিহীন অনেক গাড়ি চলমান, যা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে আরও রয়েছেÑট্রাফিক বিধি লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই, চালকদের ওভারটেকিং, বিরতিবিহীন লম্বা সময়কাল গাড়ি চালানো, ছোট গাড়ির চালক বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে সতর্কতার অভাব, দূরপাল্লার সড়ক ও জনবহুল এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়কের বেহাল অবস্থা ইত্যাদি।
সড়ক পরিবহন আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী, যানবাহনে অতিরিক্ত ওজন বহন দণ্ডনীয় অপরাধ। ৮৬ ধারা অনুযায়ী, এ অপরাধের শাস্তি হলো অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে দায়ী ব্যক্তি। এছাড়া অতিরিক্ত হিসেবে চালকের নিবন্ধন থেকে ২ পয়েন্ট কাটা যাবে। কিন্তু তারপরও চালকরা অতিরিক্ত ওজন বহন করে যানবাহনে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত ওভারলোডিং। ২০২১ সালে যা বন্ধে সারাদেশে ২৮টি এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন বা ওজন পরিমাপক কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প চলছে ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকায়। কিন্তু এটা কার্যকর হয়েছে কিনা সন্দেহ। দ্রুত এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। কারণ, অতীতে নির্মিত ১৭ এক্সেল লোড কন্ট্রোল সেন্টারের ১২টি বিকল। ফলে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন ধরা পড়ে না। যার কারণে দুর্ঘটনা আরও বেড়ে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে মালিকদের আরও বেশি সচেতন হওয়া বা কম মুনাফা লাভের আশা করা দরকার। অর্থাৎ যাতে তাদের পরোক্ষ নির্দেশে ট্রাক বা গাড়িতে বেশি ওজন বহন করতে না পারে।  
এছাড়াও চালকের লাইসেন্স পাওয়ার সিস্টেমে দুর্বলতা এবং তাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। আইনের বাস্তব প্রয়োগ সড়কে তেমন কার্যকরী হিসেবে দেখা যাচ্ছে না। চালকরা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আটক হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। এছাড়াও দুর্ঘটনার দায়ী ব্যক্তিদের তেমন শাস্তি হয় না। কারণ, আইনে তেমন শক্তিশালী শাস্তির বিধানও নেই এবং নতুন সড়ক পরিবহন আইনও শিথিল করা হয়েছে। যার সুযোগ নিচ্ছে পরিবহন মালিক, শ্রমিক এবং চালকরা। ফলে চালকেরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে ভয় পাচ্ছে না। এর বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যাও কম নয়। এটিও একটি কারণ সড়ক দুর্ঘটনার। দুর্ঘটনা কমানোর জন্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত তাদের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না। বিশেষ করে, নিরাপদ সড়ক নিশিচত করার জন্য দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই। পুলিশ মাঝেমধ্যে গাড়ি থামিয়ে শুধু মাদক আছে কি না তা চেক করে থাকে। কিন্তু সড়কে বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে না। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটিই বেড়ে চলছে।
সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে দেশের সকল বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা উচিত। এর পাশাপাশি পরিবহন মালিক, চালক, যাত্রী ও পথচারীদের সচেতন করার লক্ষ্যে লিফলেট, পোস্টার ও স্টিকার বিতরণ করতে হবে। সড়কে নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন এবং যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে। যাতে গাড়ি চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে ভয় পায়। পরিবহনের সাথে জড়িত সকলের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে মানুষের জীবনের মূল্য, পেশাগত দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। এছাড়াও দালাল বা তদবিরের মাধ্যমে ড্রাইভিং এর ভুয়া লাইসেন্স দেওয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
দুর্ঘটনা ঘটলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে দোষীদের শাস্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু যেকোন দুর্ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শোচনীয় অবস্থা থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য সরকার আইনের সংশোধনপূর্বক তা কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে সড়কে নিরাপদ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। এছাড়াও পুলিশকে আইনের প্রয়োগ বিষয়ে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালকরাই যে দায়ী তা নয়। রাস্তার পাশের হাটবাজার, দোকান ও স্কুল প্রতিষ্ঠা, অনেক সময় যাত্রী, পথচারী, শিশুদের দৌড়ে রাস্তা পার হওয়াও দায়ী। আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকার আরও কঠোর হবে বলে আমার বিশ্বাস করি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়,ময়মনসিংহ

×