ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১

নতুন সমীকরণে আন্তর্জাতিক রাজনীতি

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২০:১২, ১৪ মার্চ ২০২৫

নতুন সমীকরণে আন্তর্জাতিক রাজনীতি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই পুতিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এরই মধ্যে উভয় প্রেসিডেন্ট ফোনে কথা বলেছেন, দুই দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন এবং ভবিষ্যতে আরও কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকও রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের এসব উদ্যোগের জবাব তৈরি করতে ইউরোপ ও ইউক্রেনের এখন নাভিশ^াস উঠেছে। এতে করে ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়াকে তার প্রত্যাশিত অবস্থানে নিয়ে গেছে বৈশি^ক রাজনীতির চূড়ায়। কোনো প্রকার ছাড় না দিয়েই নিজেকে এমন অবস্থানে নিতে চেয়েছিল মস্কো। ক্রেমলিন রাশিয়ার জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলকে দেখাতে চায় যে, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়াকে একঘরে করার পশ্চিমাদের চেষ্টাব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার উষ্ণ সম্পর্কেও সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আশ^াস দিলেও তাঁর আরোপিত শুল্কনীতি থেকে রাশিয়াও রক্ষা পায়নি। ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পরই রাশিয়ার বিরুদ্ধেও একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের উত্তেজনাপূর্ণ বাক্য বিনিময়ের পর ইউক্রেনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বন্ধুত্ব জোরদার করতে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ট্রাম্প। এ বিষয়ে একটি খসড়া তালিকা প্রস্তুতের জন্য হোয়াইট হাউস পররাষ্ট্র ও ও রাজস্ব দপ্তরকে নির্দেশ প্রদান করেছে। এর অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মস্কোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও মসৃণ করা। রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, খসড়া তালিকায় উঠে আসা বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগামীতে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করবে। বর্তমানে নির্দিষ্ট কয়েকটি সংস্থা এবং ব্যক্তির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার জন্য একটি প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। রয়টার্স জানিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প এবং তার পরামর্শদাতারা কোনো চুক্তি করতে চাইছেন। এ কারণেই রাশিয়ার ওপর কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে চাইছেন।
রাশিয়া পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। দেশটির জ¦ালানি ব্যবস্থার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যদি শিথিল করা হয়, তবে এটি জ¦ালানি দাম বৃদ্ধি রোধ করতে সহায়তা করবে। ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পরই রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য পুতিনের সঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন আর রাশিয়ার ওপর সাইবার নজরদারি চালাবে না বলে জানিয়েছে। সিএনএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার কমান্ড রাশিয়ার বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত নজরদারি স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের চেয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার বিষয় হলো অবৈধ অভিবাসী। পুতিনকে নিয়ে বেশি না ভেবে অভিবাসন সংক্রান্ত সমস্যার দিকেই ট্রাম্প বেশি নজর দিতে চান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসন ইতোমধ্যেই স্পষ্ট জানিয়েছে, তারা মস্কোর সঙ্গে দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে চায়। এর ফলে ইউক্রেন বিভক্ত হয়ে পড়বে। দেশটি মার্কিন বা ন্যাটোর নিরাপত্তা নিশ্চয়তা থেকে বঞ্চিত হবে। আর মার্কিন কোম্পানিগুলো সেখানে ঢুকে কৌশলগত খনিজ সম্পদ লুটে নেবে। এটা পরিষ্কার যে, ট্রাম্প প্রশাসন আসলে জেলেনস্কির সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের কোনো ইচ্ছে নেই। জেলেনস্কির জন্য এটি ভালো হবে যদি তিনি ইউরোপীয় সমর্থকদের ওপর তাদের প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়ন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। ইউক্রেনের খনিজ সম্ভাবনাকে দেখিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোকে উৎসাহিত করতে পারেন। ট্রাম্প বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমেরিকার সমর্থন তার সঙ্গে আছে, ততক্ষণ এ লোকটা শান্তি চাইবে না। এরপর তিনি ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে: কিয়েভ যেন নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং পুতিনের শর্ত মেনে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা স্থগিত করার সিদ্ধান্তকে মস্কো স্বাগত জানিয়েছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র মিমিত্রি পেসকভ বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র এ সহায়তা বন্ধ বা স্থগিত করে, তাহলে এটি সম্ভবত শান্তির জন্য সর্বোত্তম অবদান হবে। একদিন পর্যন্ত ট্রান্সআটলান্টিক মৈত্রীই ছিল ইউরোপীয় নিরাপত্তার ভিত্তি। এই মৈত্রী কয়েক দশক ধরে ইউরোপের সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে। দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষা ছাতার নিচে ছিল। যেকারণে প্রতিরক্ষা খাতে ইউরোপীয় দেশগুলোর বেশি ব্যয় করতে হয়নি।  এখন ট্রাম্প হয়তো ইউক্রেনের জন্য মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যপ্রবাহ বন্ধ করে দিতে পারেন। অথবা ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইউক্রেনের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলোকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে ইউক্রেনকে সহযোগিতা দিতে পারে। ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির উত্তেজনাপূর্ণ বাক্য বিনিময়ের পর ইউরোপীয় নেতাদের জেলেনস্কির পােিশ দাঁড়ালেও ন্যাটোর মহাসচিব ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের একটি উপায় খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন। যুক্তরাজ্য একটি বিবৃতিতে বলেছে, সকল পক্ষের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, যত দ্রুত সম্ভব ইউক্রেনের জন্য একটি স্থায়ী ও নিরাপদ শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁও ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির আলোচনার আগ্রহকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেনের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেন ছাড়াও ইউরোপীয় দেশগুলোর নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি অনেক সংশয় দেখা দেবে। এ উদ্বেগের কারণ ট্রাম্পের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা।
যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভের জন্য সকল প্রকার সামরিক সহযোগিতা স্থগিত ঘোষণার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য ট্রাম্পের শক্তিশালী নেতৃত্বে কাজ করতে প্রস্তুত। হোয়াইট হাউসে সংঘটিত বাগবিতণ্ডার ঘটনাটিকে তিনি দুঃখজনক বলেও উল্লেখ করেন। জেলেনস্কি বলেন, এখন পরিস্থিতি ঠিক করার সময় এসেছে। দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার জন্য প্রস্তুত উল্লেখ করে জেলেনস্কি লিখেছেন, আমরা দ্রুত যুদ্ধ শেষ করতে প্রস্তুত। এবং প্রথম ধাপে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি ও আকাশে যুদ্ধবিরতি- ক্ষেপণাস্ত্র, দূরপাল্লার ড্রোন, জ¦ালানি ও অন্যান্য বেসামরিক অবকাঠামোতে হামলা নিষিদ্ধ করা এবং সমুদ্রে যুদ্ধবিরতি অবিলম্বে কার্যকর করা যেতে পারে, যদি রাশিয়া একই পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তিনি আরও বলেন, এরপর আমরা দ্রুত পরবর্তী ধাপগুলো শেষ করতে চাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে একটি শক্তিশালী চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছাতে কাজ করতে চাই। তিনি বলেন, এটি দুঃখজনক যে, বিষয়টি এভাবে ঘটে গেছে। এখন আমরা চাই ভবিষ্যতে সহযোগিতা ও যোগাযোগ আরও গঠনমূলক হোক। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে খনিজ সম্পদ চুক্তি ব্যর্থ হওয়া প্রসঙ্গে জেলেনস্কি বলেন, ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ওই চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার পর ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খনিজ সম্পদ চুক্তি স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত রয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধে ইউক্রেনকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি ট্রাম্পের প্রশংসা করে বলেন, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে, আমরা সেটিকে সত্যিই মূল্যবান মনে করি। আমাদের সেই মুহূর্ত মনে আছে, যখন ট্রাম্প ইউক্রেনকে জ্যাভলিন মিসাইল দিয়েছিলেন, যা যুদ্ধের পরিস্থিতি বদলে দিয়েছিল। তিনি এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেরন। এক সাক্ষাৎকার তিন বলেছেন, আমি আমেরিকান জনগণের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, তাদের সকল ধরনের সহােগিতার জন্য।
এদিকে ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক দেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ এবং মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে। ট্রাম্পের সমালোচক এবং ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর ক্রিস মার্ফি মন্তব্য করেন, হোয়াইট হাউস এখন ক্রেমলিনের অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। মনে হচ্ছে, আমেরিকা এখন একনায়কদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে। তবে রিপাবলিকান পার্টির নেতারা বলছেন, জেলেনস্কির উচিত এখন পদত্যাগ করা, যাতে মস্কোর সঙ্গে শান্তি চুক্তি করা যায়। ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালজ সিএনএনকে জানান, আমাদের এমন একজন ইউক্রেনীয় নেতা প্রয়োজন যিনি আমাদের সঙ্গে চুক্তি করতে পারবেন এবং পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার সঙ্গেও চুক্তি করেÑ এ যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবেন। এদিকে হোয়াইট হাউসে অপদস্থ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে চাইছেন ইউক্রেন। এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিমে রাশিয়াকে পৃথক করে দেওয়াÑ এসকল বিষয়ের মধ্যে পুতিনের দিকি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দুই দেশের মধ্যে একটি পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে এমনও অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য চীন রাশিয়াকে সহযোগিতা করছে। তবে সে অভিযোগ চীন বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। এখন পুতিনের প্রায় কথাই ট্রাম্প মেনে নিচ্ছেন। রাশিয়ার জন্য মঙ্গলজনক কোনো চুক্তিও সামনে হতে পারে; যেখানে হয়ত চীনের ভূমিকা নাও থাকতে পারে। যদিও কয়েক সপ্তাহ আগেও দৃশ্যপট অনেকটাই ভিন্ন ছিল। ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় চীনেরও ভূমিকা থাকার কথা ছিল। তবে বর্তমান পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈশি^ক শক্তি বা রাশিয়ার মিত্র হিসেবে আলোচনার টেবিলে চীন নেই। বিষয়টি চীনের কর্মকর্তাদের কিন্তু অবাক করেছে। গত মাসে সৌদি আরবের রিয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের নেতৃত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় দফার বৈঠকের জন্য প্রস্তুতি চলমান। এ আলোচনাকে কেন্দ্র করে এ দুই পরাশক্তি বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখছে। ক্রেমলিনের প্রধান অর্থনৈতিক দূত কিরিল দিমিত্রিয়েভ জানিয়েছেন, এই আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে জ¦ালানি ক্ষেত্রে সহযোগিতার সুযোগ তৈরি হবে। ফিন্যান্সিয়াল টামইমস জানিয়েছে, রাশিয়ার নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প পুনরায় চালু করতে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। জার্মানি এই প্রকল্প স্থগিত করেছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর। দিমিত্রিয়েব বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের উচিত রাশিয়ার সঙ্গে মানবতার একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। যেখানে বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন এবং মহাকাশ গবেষণার মতো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হবে। তিনি ইলন মাস্কের এক্স প্ল্যাটফর্মে একটি কম্পিউটার গ্রাফিক্স শেয়ার করেছেন, যেখানে একটি কল্পিত যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া-সৌদি মহাকাশ মিশন দেখানো হয়েছে; যা স্পেসএক্স রকেট ব্যবহার করে মঙ্গল গ্রহে অভিযান চালাচ্ছে। অর্থনৈতিক লাভের দিক থেকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার বিষয়টি আকর্ষণীয় মনে হলেও, এটি কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসনের নীতিগুলো রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে একটি নতুন গতিশীলতা এনেছে। নতুন মার্কিন প্রশাসন অতি দ্রুততার সঙ্গে তাদের বৈদেশিক নীতির কাঠামো পরিবর্তন করেছে; যা অনেকটাই রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
ট্রাম্প ফেব্রুয়ারিতে পুতিনকে অনুরোধ করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য। আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতি ইরানের সমর্থন। রাশিয়া এ প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের এমন পদক্ষেপ গ্রহণকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস হিসেবে দেখছেন। কারণ ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন এবং ২০১৮ সালে একতরফাভাবে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে এবার তিনি সামরিক উত্তেজনা প্রশসন করে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা করছেন। রাশিয়া বিশ^াস করে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান আলোচনার মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান করবে এবং মস্কো এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা এখন খুবই জরুরি। দুই দেশের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ক যুদ্ধ ও পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের ঝুঁকির দিকে এগুচ্ছে। রাশিয়া অতীতেও যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কেও বিভিন্ন ইস্যুতে মধ্যস্থতা করেছে। রাশিয়াকে মধ্যস্থতা করতে আহ্বান জানানোর কারণ হলো মস্কো ও তেহরানের ঘনিষ্ঠ সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক। গত জানুয়ারি মাসে দুই দেশ ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, জ¦ালানি ও বাণিজ্যের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দুটি ভিন্ন প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভোট দিয়েছে রাশিয়ার পক্ষে। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদেও যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রস্তাবে রাশিয়ার সমালোচনা করা হয়নি। এর মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন নিজেদের অবস্থান আরও স্পষ্ট করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোড়া লাগানোর ইঙ্গিত প্রদান করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ইউক্রেন সংকট নিরসনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের যৌথ অর্থনৈতিক প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করছে। রাশিয়া তাদের শিল্পগুলোর বিকাশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি কোম্পানি এবং সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ট্রাম্প ও পুতিন নতুন মৈত্রীর পথে এগিয়ে গেলে বিশ^ রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। দ্বিমেরু ব্যবস্থা ভেঙে গিয়ে বহুমেরু ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে পারে বিশ^ব্যবস্থা। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য পুনর্গঠিত হতে পারে এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যার সমাধানে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হবে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের এ নতুন ধারা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে; যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও জোটের পুনর্গঠনে সহযোগিতা করবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×