ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১

রোহিঙ্গা সংকটে নতুন মাত্রা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:০৯, ১৪ মার্চ ২০২৫

রোহিঙ্গা সংকটে নতুন মাত্রা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি

দেশবাসী ও বিশ্বের সমগ্র সচেতন নাগরিক পরিপূর্ণ অবহিত আছেন, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সরকার পরিচালিত বর্বরতম অভিযানে নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রাণ রক্ষায় পালিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক এসব অসহায় মানুষকে মনুষ্যত্ব-মানবিকতায় প্রোজ্জ্বল বাংলাদেশ সাদরে বরণ করে। সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ জীবন যাপনে মৌলিক চাহিদা পূরণসহ সামগ্রিক সার্থক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশ নতুন অধ্যায় নির্মাণ করে। বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার একর ভূমি ব্যবহারকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নতুন আগমনে সাড়ে ছয় হাজার একর ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। ইতোমধ্যে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের জন্য আবাসনসহ পর্যাপ্ত সুবিধা সম্বলিত ভাসানচরে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। বিগত ১৪ মাসেও মিয়ানমারে বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন একাধিক শহরের পতন হওয়ায় আরও প্রায় ৭০ হাজার শরণার্থী অনুপ্রবেশ করেছে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা আরাকান আর্মির নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গা আসা অব্যাহত থাকবে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে; সংকট নিরসনে তা এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ অন্তরায় বিবেচনায় এ নিয়ে সচেতন মহলে নানামুখী কৌতূহল বাসা বেঁধেছে। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য; রোহিঙ্গা সংকট একটি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে। এত বিশালসংখ্যক বিদেশী শরণার্থীর কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে অবস্থান শুধু ওই অঞ্চলে নয়; পুরো দেশেই অস্বাভাবিক ও অনাকাক্সিক্ষত দুরাশার দৃশ্যপট নির্মাণ করে। নিরাপত্তাজনিত-পরিবেশগত-নানামুখী অপরাধ সংঘটনে এ জনগোষ্ঠীর কদর্য কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় নিগূঢ় প্রতিবন্ধকতা পরিগ্রহ করেছে। মূলত এ সমস্যা সমাধানের মূলে রয়েছে মিয়ানমার সরকারের আগ্রহ ও ঐকান্তিক স্বদিচ্ছা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যথার্থ চাপ প্রয়োগ ও প্রভাব বিস্তারে যৌক্তিক সমাধান নির্ধারণের বিপরীতে পরাক্রমশীল দেশসমূহের উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ক্রমাগত ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্কের সমৃদ্ধি সমস্যাকে প্রলম্বিত করছে।
একদিকে লুম্পেন বিশ্বায়ন মোড়কে কথিত ভোগবাদী বিশ্বের বিলাসবহুল দিনানিপাত, অন্যদিকে তাদেরই কদর্য ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি-বাজার দখল, আধিপত্যবাদে সৃষ্ট দরিদ্র দেশসমূহে অনুন্নয়নের উন্নয়ন চৌহদ্দির বিকাশ বিস্তৃত হচ্ছে। ক্ষুধা-দারিদ্র্য-পুষ্টিহীনতা-অস্বাস্থ্যকর অবস্থার করুণ দৃশ্যাদৃশ্য বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে গভীর রক্তক্ষরণ অব্যাহত রয়েছে। বিপরীতে পশুতুল্য এসব অর্থ-ক্ষমতা-প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর লিপ্ত জাতিরাষ্ট্র তাদের শোষণ-শাসনের যাঁতাকলের অপকৌশল সক্রিয় করেছে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে একই ধারাবাহিকতায় তাদের মুখরোচক বাচনিক আশ্বাস বাস্তবায়নে এখনো ফলপ্রসূ অর্জন গোচরীভূত নয়। সাত বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কার্যকরণে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে আরোপিত পাঁচটি শর্তকে মোটেও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। উপরন্তু ২০২৪ সালের শুরু থেকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ চলমান থাকায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালে ডিসেম্বর মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য যে পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল তাও থেমে যায়। মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসার কোনো লক্ষণ অনুভূত নয়। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার পাশাপাশি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের বর্তমান অন্যতম শক্তিশালী দেশ চীনের পক্ষ থেকে আশানুরূপ কোনো উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়।  
অতিসম্প্রতি জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জরুরি তহবিলের অভাবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য রেশন কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি মারফত জানা যায়, রোহিঙ্গাদের জন্য পূর্ণ রেশন চালিয়ে যেতে এপ্রিলে ১৫ মিলিয়ন ডলার এবং বছরের শেষ পর্যন্ত মোট ৮১ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এ মাসের মধ্যে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা জোগাড় করতে না পারলে ১ এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারের বরাদ্দ অর্ধেক কমানো হতে পারে। বর্তমানে একজন রোহিঙ্গা মাসে ১২ দশমিক ৫০ ডলার মূল্যের খাদ্য সহায়তা পেয়ে থাকে, যা কমিয়ে ৬ ডলারে আনা হবে। ফলে প্রতি বেলার খাবারের জন্য বরাদ্দ বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৬ টাকা থেকে কমে হবে ৮ টাকা। এতে আগে থেকেই বিরাজিত খাদ্য সংকট এবং অপুষ্টি আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। প্রাসঙ্গিকতায় ডব্লিউএফপির বাংলাদেশ মুখপাত্র কুন লি গণমাধ্যমে বলেন, ‘মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে অনুদান সংকটের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদান কমে আসছে। এর আগে ২০২৩ সালে তহবিল ঘাটতিতে রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু মাসিক খাদ্য সহায়তা ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে প্রথমে ১০ মার্কিন ডলার এবং পরে ৮ মার্কিন ডলারে করা হয়। পরবর্তীতে তা আবার বাড়ানো হয়।’
উক্ত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মাঝে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা নেতাসহ অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের দাবি, অর্থ সহায়তা কমিয়ে আনলে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের জনজীবন বিপর্যস্ত হতে পারে। কারণ এত অল্প টাকায় তারা না খেয়ে মরবে। বাড়তে পারে খুন-ধর্ষণ-মাদক ও মানব পাচার-ছিনতাই-ডাকাতিসহ নানা অপরাধ। উল্লেখ্য, খাদ্য সহায়তায় বরাদ্দ কমার ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব পড়তে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি। সামজিক মাধ্যম এক্স-এ দেওয়া পোস্টে তিনি বলেন, ‘যদি শিবিরগুলোয় দাতাদের সহায়তা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়, যা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছেÑ তাহলে বাংলাদেশ সরকার, সাহায্য সংস্থা ও শরণার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং এর ফলে হাজার হাজার মানুষ ক্ষুধা, রোগ এবং নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পড়বে।’
বিজ্ঞজনদের দাবি, খাদ্য সংকট দেখা দিলে রোহিঙ্গারা জীবিকার প্রয়োজনে বাংলাদেশের মূল স্রোতধারায় মিশে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে অসংখ্য রোহিঙ্গা দেশের জনগোষ্ঠীর ভেতরে মিশে গেছে। শুধু তাই নয়, নানা উপায়ে তাদের অনেকে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রও সংগ্রহ করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মধ্য দিয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে রোহিঙ্গা শিবিরের বাইরেও। সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়ে দীর্ঘমেয়াদে দেশের স্থিতিশীলতায় ব্যাঘাত ঘটার বিষয়টিও অমূলক নয়। আরও রয়েছে বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠী তৈরির আশঙ্কা। আর সেই সুযোগে দেশী-বিদেশী গোষ্ঠী যারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাখতে চায়, তাদের কাছ থেকে তারা অস্ত্র সহায়তা পাবে। যেসব অস্ত্র তারা ব্যবহার করতে পারে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে।
তাছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডির কার্যক্রম স্থগিত করার কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল ও ক্লিনিক। ভবিষ্যতে আরও বন্ধের প্রক্রিয়াধীন। এতে দৈনিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রায় ৭০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা। ক্যাম্পে স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত কর্মকর্তাদের অভিমত, ইউএসএআইডির তহবিল স্থগিত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। তারা সবাই ২০-২৫ শতাংশ সেবা হ্রাস করেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিওদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টার সেক্টর কোর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) কর্তৃক সংবাদ মাধ্যমে প্রেরিত বিবৃতিতে জানা যায়, বৈদেশিক সাহায্য স্থগিত হওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় ও জীবন রক্ষাকারী সেবাসহ বেশকিছু সেবা বন্ধ হয়ে গেছে, যা রোহিঙ্গা ও হোস্ট কমিউনিটিতে প্রভাব ফেলছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কিছু সহায়তা স্থগিতাদেশ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরে এর প্রভাব স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে কী হতে পারে তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে সময় লাগবে। উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে জরুরিভিত্তিতে আর্থিক সহায়তার আবেদন করেছে ডব্লিউএফপি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য জাতিসংঘের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং বাংলাদেশকে এ সমস্যার জন্য তহবিল নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছেন।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত। চলতি মাসের ১১ তারিখ সম্মানিত পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আসিয়ানের বিশেষ দূত ওথমান হাশিম এর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আসিয়ান, জাতিসংঘ এবং দাতা দেশগুলোকে নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে রোডম্যাপ তৈরির জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীতার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আসন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনকে সফল করার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা প্রধানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ সম্মেলন থেকে তিনি কিছু বাস্তবসম্মত অগ্রগতি হওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে একটি সুনির্দিষ্ট পথ থাকা দরকার বলে মন্তব্য করেন। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ১৩ মার্চ থেকে জাতিসংঘ মহাসচিবের চারদিনের বাংলাদেশ সফর কী বার্তা দেবে দেশের জনগণ সেদিকে তাকিয়ে আছে। লাখো রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতার গ্রহণের পরিকল্পনা উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে কতটুকু অর্থবহ হবে তা দেখার বিষয়। এটি স্পষ্ট যে, তাঁর এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ফল শূন্য বা প্রয়োগিক অর্জন ব্যতিরেকে এ সফরের মূল্য ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে। দেশবাসী অধীর আগ্রহে ইতিবাচক ও যৌক্তিক যোগফলে দেশের প্রভূত সম্ভাব্য সমস্যা দূরীকরণে অচিরেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রত্যাশা করছে।   
লেখক : শিক্ষাবিদ

×