ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১

কি অপরাধ ছিল শিশুটির

প্রকাশিত: ২০:০০, ১৪ মার্চ ২০২৫

কি অপরাধ ছিল শিশুটির

৮ বছরের এক শিশু। তার শরীরও কি বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে! অথচ এ বয়সের একটা শিশুকে তিনজন মিলে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। তাও আবার অন্য কেউ নয়, নিজের বোনের শ্বশুর, স্বামী ও দেবর। মাগুরায় ৮ বছরের শিশুটি বড় বোনের শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসে এমন পাশবিক নৃশংসতার শিকার হয়। অপরাধীরা ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে নির্মম নির্যাতনও করেছে। শিশুটি আশঙ্কাজনক অবস্থায় আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েও বাঁচতে পারেনি। এ ঘটনায় দেশের সর্বস্তরের মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে বিচার চেয়েছেন, নিন্দা জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে শিশুটির বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাসুরকে। কতটা সাইকোপ্যাথ হলে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বউয়ের ছোট বোনকে কেউ ধর্ষণ করে! মানে এতটা অধঃপতন হয়েছে কিছু মানুষের! মাগুরার শিশুটির ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আইন উপদেষ্টাও এই বিষয়ে জোর দিয়েছেন।  
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সাড়ে ৩ বছরে ২২০৪ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাস পর্যন্ত ২২৪ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুসারে, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৩ হাজার ৪৭১ জন মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরিসংখ্যান দেখে এটা অন্তত বোঝা যায়, আমাদের মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করছে। এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া সেটিরই প্রতিফলন। গবেষণায় দেখা যায়, ঘরে ঘরে নিকটাত্মীয় কর্তৃক ধর্ষিত ও যৌন নিপীড়নের শিকার বেশি হয় শিশুরা। শিশু-কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে পরিবারে, নিকটাত্মীয় দ্বারা। এসব ঘটনার অনেক কিছুই প্রকাশ পায় না। একইভাবে শিক্ষিত মহল, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের মধ্যেও অনেক দুর্ঘটনা রয়েছে, যা প্রকাশ পায় না।
সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়া, মূলত পারিবারিক ও সামাজিক প্রথা ও সংস্কার ধূলিসাৎ, সামাজিক ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয়, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার বিশেষ করে ল্যাপটপ-কম্পিউটার-মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও জবাবদিহিবিহীন ব্যবহারের সুযোগ, পর্নোগ্রাফির অবাধ বিস্তার ইত্যাদি কারণে। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকের আগ্রাসন ধর্ষণের ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, দুর্বল সামাজিক কাঠামো, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র্য, বিচারহীনতা। আরও রয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় সংস্কৃতি চর্চার অভাব, সুষ্ঠু ও সুস্থ ধারার বিনোদনের অনুপস্থিতি, কিশোর-কিশোরীদের ক্রীড়া-কর্মকাণ্ডের অভাব ইত্যাদি। এর চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, সমাজে যতসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা আমরা শুনি, ততটার বিচারের খবর আমরা পাই না। গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর তেমন একটা দেখা যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষকরা শুধু পারই পায় না, পুরস্কৃতও হয়।
ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র। যদি ধর্ষককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে এ ঘটনা হ্রাসের পাশাপাশি বন্ধও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সমাজ এবং পরিবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ সুগঠিত ও সুসংগঠিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার ও অশুভ বিস্তার ঠেকাতে হবে। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক উপাদানও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এসবের দায়িত্ব প্রধানত রাষ্ট্রের। আর রাষ্ট্রকে সাহায্য করতে হবে আমাদের। পাশাপাশি আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করতে হবে। তাহলেই আমরা এই ভয়াবহতা এবং অমানবিকতা থেকে রক্ষা পেতে পারি।

আজহার মাহমুদ
খুলশী-১, চট্টগ্রাম

×