ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫, ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১

যুগে যুগে মীরজাফর

ড. ইউসুফ খান

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১৩ মার্চ ২০২৫

যুগে যুগে মীরজাফর

বিশ্বাস শব্দটি ছোট হলেও এর তাৎপর্য অনেক বড়। বিশ্বাস অর্জন করতে সময় লাগে বছরের পর বছর। কিন্তু ভাঙতে সময় লাগে কিছুক্ষণ। একজন ভালো মানুষ বা ভালো বন্ধু হওয়ার প্রথম শর্ত হলো বিশ্বাসী হওয়া। বিশ্বাস যদি ভালোবাসার প্রথম ধাপ হয়, তাহলে বিশ্বাসঘাতকতা হলো সম্পর্কের শেষ ধাপ। বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছেন, ‘সব অপরাধের চেয়ে বড় অপরাধ হলো বিশ্বাসঘাতকতা’।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু সেরা জীব হলেও মানুষের মধ্যে অনেক ঘৃণিত অভ্যাস রয়েছে, যার অন্যতম হলো বিশ্বাসঘাতকতা। পৃথিবীর সর্বত্রই এমন কিছু ঘৃণ্য স্বভাব-চরিত্রের মানুষ খোঁজে পাওয়া যায় যারা অতীতের সব উপকার অস্বীকার করে উপকারীর বুকে ছুরিকাঘাত করতে দ্বিধা বোধ করে না। যুগে যুগে এমন কিছু বেইমান  বা বিশ্বাসঘাতকের আবির্ভাব ঘটে, যাদের কারণে জাতি বা রাষ্ট্রকে পর্যন্ত চরম মূল্য দিতে হয়। এমনই একজন  জঘন্য প্রকৃতির বিশ্বাসঘাতক মানুষ ছিলেন মীরজাফর আলী খান।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার করুণ পরাজয়ের কাহিনী আমরা সবাই জানি। এর নেপথ্যে ছিলেন কুচক্রী বিশ্বাসঘাতক প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খান। ক্ষমতার মোহ আর সম্পদের লোভ তাকে পেয়ে বসে। রাতের অন্ধকারে ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়কে নিশ্চিত করেন তিনি। বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের কারণেই দুইশ’ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে হয় বাঙালি জাতিকে। তবে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করেনি। জীবনের শেষ পরিণতিই তা প্রমাণ করে। হাদিসের বর্ণনায় রয়েছে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ হলো দুমুখো মানুষ। তাদের মুখে এক অন্তরে আরেক। আর এর জন্য পরিণাম হয় ভয়াবহ।
তবে ইতিহাস একথাও বলে, মীরজাফর কখনোই মূল বিশ্বাসঘাতক ছিল না। মীরজাফর ছিল বিশ্বাসঘাতকদের বানানো একটা হাতের পুতুল, যার নিজের কোনো যোগ্যতা ছিল না। যখনই তার দ্বারা বিশ্বাসঘাতকদের স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে, তখনই তাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বেরিয়ে এসেছে প্রকৃত চক্রান্তবাজদের চেহারা।
মীরজাফরের আবির্ভাব ঘটেছিল অনেক পরে। নবাব সিরাজ-উ-দৌলাকে যে সরাতে হবে তার প্ল্যান অনেক আগেই করে রেখেছিল তিন বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও রাজবল্লভ মিলে। জগৎশেঠের বাড়িতে এক গোপন মিটিং হয়। সেই মিটিংয়ে মহিলার ছদ্মবেশে পালকিতে করে যোগ দিয়েছিল ইংরেজ দূত ওয়াটস। মিটিং-এ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় ছলেবলে-কৌশলে সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করা হবে। তবে কোনোভাবেই মুসলমানদের উত্তেজিত করা যাবে না। মি. ওয়াটস তখন বলে, সিরাজের সঙ্গে লড়তে গেলে বিরাট অর্থের প্রয়োজন হবে। তা আমরা কোথায় পাব, উত্তরে জগৎশেঠ বলে, টাকা যা লাগে আমি দেব কোনো চিন্তা নেই।
এ মিটিংয়ের পর সিরাজকে সরাতে ঘসেটি বেগমকে বোঝানোর দায়িত্ব ছিল রাজা রাজবল্লভের ওপর। আর মীরজাফরকে বুঝানোর দায়িত্ব ছিল উমিচাঁদের ওপর। দ মীরজাফরকে লোভ দেখায় এবং বলে, তুমি আমাদের দলে থাকলে তোমাকে পরবর্তীতে সিংহাসনে বসানো হবে। এরপর জগৎশেঠের বাড়িতে দফায় দফায় মিটিং হয়। সেখানে উপস্থিত থাকে জগৎশেঠ, রাজা রায় দুর্লভ, রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ওই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় মীরজাফরকে দিয়েই সিরাজকে সরাতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল। সিংহাসনের লোভে মীরজাফর যেন উন্মাদ হয়ে গেল। তার অধীনের সৈন্যবাহিনী যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজয় বরণ করতে হয়। অর্থাৎ বাংলার পতনের মূল কারণ ছিল মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা। ওইসময় মীরজাফর এতটাই বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠে যে, ক্ষমতার লোভে নবাবকে ধ্বংস করার জন্য সে যে, সংকল্পবদ্ধ তা কোনোভাবেই সিরাজকে বুঝতে দেয়নি। উল্টো পবিত্র কুরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করে বলে যে, বাংলার মসনদের প্রতি তার কোনো মোহ নেই। যে কোনো মূল্যেই হোক পলাশীর যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনবে। আর সেই কি না এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল!
এজন্যই মীরজাফর নামটি এখন বাংলার মানুষের কাছে একটি ঘৃণিত নাম, যার প্রতিশব্দ হলো বেইমান। নামটি গালি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। কোনো বাঙালিই তার সন্তানের নাম মীরজাফর রাখে না। এটি একটি ঐতিহাসিক চরিত্র হলেও মীরজাফর শব্দটি বিশ্বাসঘাতকের অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে। যতদিন বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস থাকবে, ততদিন পর্যন্ত নামটি নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হবে।
আমাদের আশপাশে যেসব মানুষ আছে তাদের অনেকের মধ্যে মীরজাফরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে। তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে। এ সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে যারা কাজ করে তারা এদেশেরই কিছু সংখ্যক বেইমান-বিশ্বাসঘাতক মানুষ। নিজেদের স্বার্থে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তারা। রাজাকার, আলবদর, আলশামস তো মীরজাফরেরই অন্য একটি রূপ।
ইতিহাসের নিকৃষ্টতম চরিত্র মীরজাফর মরে গেলেও বিশ্বাসঘাতকের বেশে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে তার প্রেতাত্মারা আমাদের চারপাশে, যা ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই তো মীরজাফররা যুগে যুগে। তাদের রুখে দিতে আমাদের হতে হবে বদ্ধপরিকর।
একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। একবার বাদশাহ হারুনুর রশীদের কাছে এক লোক একটি চাতক পাখি বিক্রি করার জন্য নিয়ে এলো। তিনি দাম জিজ্ঞেস করলে সে বাজারমূল্যের চেয়েও অনেক বেশি দাম চাইল। বাদশাহ জানতে চাইলেন, পাখিটির এত দাম কেন? অথচ তার একটি পা নেই!
লোকটি বলল, মার্জনা করবেন জাঁহাপনা! দেখতে সাধারণ হলেও এটি আসলে একটি বিশেষ ধরনের পাখি। এর বিশেষত্ব হলোÑ আমি যখন শিকারে যাই, তখন এই চাতক পাখিটিকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাই। আমার পাতানো ফাঁদের সঙ্গে এই পাখিটিকেও বেঁধে রাখি। এই পাখিটি তখন এক অদ্ভুত আওয়াজ করে অন্য পাখিদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তার এই আওয়াজ শুনে ঝাঁকে ঝাঁকে অন্য পাখিরা এসে জড়ো হয়। তখন আমি একসঙ্গে সব পাখিকে শিকার করি। বলা যায় এই পাখিটিই আমার শিকারের প্রধান ফাঁদ।
বাদশাহ খুব মনোযোগসহকারে শিকারির সকল কথা শুনলেন এবং তার চাহিদা অনুযায়ী চড়া দামেই পাখিটি কিনলেন। তিনি মনে মনে এ কথাও ভাবলেন, এ দুষ্ট পাখিটির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে পাখিটাকে জবাই করে ফেললেন। শিকারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জাঁহাপনা! অনেক দামে কেনা পাখিটি এভাবে জবাই করে দিলেন?
তখন বাদশাহ হারুনুর রশীদ তাকে বললেন, ‘যে তার স্বজাতির সঙ্গে অনায়াসে এমন গাদ্দারি করতে পারে, তার এই পরিণতিই হওয়া উচিত’!
লেখক : চেয়ারপারসন, ব্যুরো বাংলাদেশ

×