
মাহে রমজান মু’মিন জীবনে এক স্বর্গীয় আমেজ ও অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসে। এ মাস আধ্যাত্মিকতা চর্চার পাশাপাশি সমাজে সাম্য, মৈত্রী ও ভালোবাসার বন্ধনকেও মজবুত করে। মুসলিম জিন্দাগানীতে এটি বিড়ম্বনামূলক কোনো মাস মনে হয় না, এ যেন এক উৎসবমুখর মৌসুম। এর দিনরাত সমান কোলাহলে ভরা। কবির ভাষায় : ‘হার রোজ রোজ ঈদ হ্যায়; হার শব শবে বরাত হ্যায়’- প্রতিদিনই যেন ঈদের দিন, প্রতিরাতই যেন ভাগ্য রজনী।
রমজানের আগমনের আগ থেকেই মু’মিনরা এ মাসের প্রতীক্ষায় থাকেন, যেমনটি কোকিল থাকে বসন্তের প্রতীক্ষায়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা জীবনে এ মাসের আগমনের জন্য দোয়া করে থাকেনÑ ‘হে আল্লাহ, আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দাও আর রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও।’ যখন আকাশে রমজানের বাঁকা চাঁদ মুচকি হাসে তখন বলেÑ ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু বিল আমনে ওয়াল ইমান ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম। অর্থাৎ, হে আল্লাহ, এ পবিত্র মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা ও ইমানের প্রতীক বানাও আর সালামাত ও ইসলামের চিহ্ন বানাও।’-(তিরমিজী)।
রমজান কিভাবে সাম্য ও মৈত্রীর বন্ধন সুদৃঢ় করে? মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, মানব প্রকৃতি তিন ভাগে বিভক্ত। যথাÑ ব্যক্তি মানুষ বা আমিত্ব, পশুত্ব বা কুপ্রবৃত্তি এবং ংঁঢ়বৎ ঊমড়-মানবতা সুপ্রবৃত্তি। ব্যক্তি মানুষ বা আমিত্ব পরিচালিত হয় পশুত্ব বা মানবিক গুণাবলি দ্বারা। মানবিক গুণাবলি বা সুপ্রবৃত্তিগুলো এনে দেয় ইসলাম নির্দেশিত শান্তি, সাম্য, শৃঙ্খলা, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসা প্রভৃতি মহৎ কর্মের প্রতি অনুরাগ। পক্ষান্তরে, পশুত্ব (কুপ্রবৃত্তি) বা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য মানব জীবনে এনে দেয় অনৈক্য, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি অমানবিক ক্রিয়াকর্ম। রমজানের সিয়াম মানব দেহ হতে সমুদয় কুপ্রবৃত্তি দূর করতে সহায়তা করে। ফলে, সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক হয় মধুময়। এতদিন ধরে যে ধনীর দুলাল বুঝতো না ক্ষুধা এবং না পাওয়ার জ্বালা কত ভয়াবহ, কত দুর্বিষহ-আজ সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে সে বুঝে নিয়েছে গরিব, দুঃখী ও সম্বলহীন মানুষের মর্মপীড়া। তার মাঝে সৃষ্টি হয়েছে মানব প্রেম। যেসব মানুষ সারারাতকে ঘুমের মধ্যে তসরুফ করত, আজ তাদের চিন্তাও বাধার সম্মুখীন হয়েছে রমজানের খতম তারাবি এবং শেষ রাতে সেহরি গ্রহণের কর্মসূচির কারণে।
রমজান যে কোনো ঘুমপ্রিয় মানুষকে একটা প্রশিক্ষণের পর্যায়ে নিয়ে আসে। ফলে তার মাঝে শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজের ব্যাপারে আগ্রহ জন্মে। যে নামাজের মাধ্যমে একজন বান্দা সহজে আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হন। এভাবে রাত্রিজাগরণ ও শব বেদারীর অভ্যাস, একান্তে নিজের জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববার ফুরসত এনে দেয় রমজানুল মোবারক।
বস্তুত রমজানুল মোবারক হচ্ছে ইবাদত-তিলাওয়াত, জিকির, পবিত্রতা ও নৈকট্য লাভের এক বিশ্ব মৌসুম। আত্মিক উৎকর্ষ ও পরকালীন কল্যাণ লাভের এক ঐশী উৎসব। পূর্ব-পশ্চিম তথা দুনিয়ার সকল অঞ্চলের সকল শ্রেণির মুসলমান সমভাবে এ উৎসবে শরিক। শিক্ষিত-অশিক্ষত, পণ্ডিত-মূর্খ, শাসক-প্রজা ও ধনী-গরিব সকলেই ইহ ও পরকালীন কল্যাণ অর্জনে এ প্রতিযোগিতায় সমান উৎসাহী। মনে হয় যেন গোটা ইসলামী উম্মাহ শান্তি কল্যাণের নুরানিয়াত ও স্নিগ্ধ জ্যোতির্ময়তার এক বিস্তৃত শামিয়ানার নিচে ঠাঁই নিয়েছে। এমনকি ইমানি দুর্বলতার কারণে সিয়ামের ব্যাপারে যারা অনীহা ও অলস তারাও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ভয়ে রোজা রাখতে বাধ্য হন। এ মাসে বিশ্বব্যাপী এমন এক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় যে, হৃদয়ের শক্ত জমিন হয়ে উঠে কোমল ও উর্বর। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আপন প্রতিপালকের ইবাদত ও আনুগত্য প্রকাশ এবং মানুষের প্রতি হামদর্দি ও সমবেদনার কোমল অনুভূতি হয়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত। এজন্য হাদিসে বলা হয়েছে হাজা শাহরুল মাওয়াসাত’: এ তো পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাহিনা। এ মাসের আপনি সেহরি অনুষ্ঠানের কথা ধরুন। শেষ রাতেও কিভাবে তখন একে অপরের সঙ্গে, এক বাড়ি অন্য বাড়ির সঙ্গে প্রাণের যোগসূত্র খুঁজে বের করে। অন্য কোনো পরিবেশে রজনীর নিঝুমতা ঠেলে এমন প্রাণবন্ত সময় তৈরি করা কি সম্ভব? উৎসাহী শিশু-কিশোর একে অপরের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কী সুন্দরভাবেই না অলিতে গলিতে গেয়ে ওঠেÑ
‘রমজানেরই রাতের শেষে
ঘুমিয়ে কেন তুমি এখন
সেহরির যে সময় হলো
উঠো উঠো মু’মিনগণ।’
একইভাবে ইফতারের সময় দিনের সমস্ত আবেগ-উচ্ছ্বাস যেন বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো উপচে পড়ে। তখন সমাজের এ কি ব্যস্ততা, একে অপরকে বিলানোর, একে অপরকে কাছে টানার। রমজান ছাড়া এ পরিবেশ কল্পনাই করা যায় না। হাজারো ব্যস্ততা ও দৈন্যতার মাঝেও কেউ কাউকে ফেলে ইফতার মুখে নেয় না। সারাদিন রোজার মতো কঠিন সাধনার পরও মু’মিন মন এ সময় এমন হয়ে যায় ভোগে নয়, ত্যাগেই যেন তার তৃপ্তি। তাই নিজের অতি সামান্য ইফতার সামগ্রীতেও সে অন্যকে সানন্দে শেয়ার করে। ইসলামের মহান নবী হযরত রাসুলে করীম (স.)ও এ মানসিকতা পোষণের জন্য উৎসাহিত করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন: মান ফাত্তারা সায়িমান কানা লাহু মাগফিরাহ- যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তার জন্য রয়েছে ক্ষমার ঘোষণা এবং রোজার সমান পুণ্য।
ইসলামের সাম্য ও ঐক্যের অনিন্দ্য সুন্দর পরিবেশকে মূর্ত করে এ সময় তাওহীদবাদী মানুষ একই হুইসেল, একই সাইরেনের সঙ্গে ‘লাব্বাইক’ বলে ওঠেন। এজন্য হাদিসে বলা হয়েছে : রোজাদারের জন্য রয়েছে দু’টো আনন্দের মুহূর্ত। এক. ইফতারের সময়, দুই. প্রভূর দিদারের সময়।
এতদিন যে মসজিদগুলো আবাদ হয়নি, মোমবাতির মৃদু আলোতে যেগুলো কোনো মতে, মুসলিম মহল্লার সাক্ষ্য বহন করত, আজ রমজানে মসজিদগুলো হয়েছে আলো ঝলমলে, এর আঙিনা মুখরিত হয়ে আছে রোজাদার, ইফতারকারী ও তারাবি আদায়কারী মুসল্লিদের কলতানে। গ্রামবাংলা যেন এ সময় নতুন প্রাণ পায়, জেগে ওঠে অনাবিল উল্লাসে। আর এ রমজানের কারণেই ঈদের মতো এক গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন হয়ে থাকে শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে। ঈদের আনন্দ বস্তুত রোজাদারেরই আনন্দ। ঈদ দেশে দেশে সাম্য-মৈত্রী-ভালোবাসার যে জয়গান গণবিদারী আওয়াজে তুলে ধরে, এর শিক্ষার উৎসমূলই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সিয়ামের মাস, রহমতের মাস রমজান। সুতরাং মাহে রমজান বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার এক অবারিত ঝর্ণাধারা।
আসলে রমজানের চাঁদ, রমজানের মাস উম্মাহর মাঝে একতা, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও সহমর্মিতার প্রতীক। এ-মাসের কল্যাণধর্মী ও আত্মগঠনমূলক ইবাদত ও বিধি-বিধানসমূহ না হলে মুসলমানদের মাঝে পূর্ণতা অর্জনের এবং একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের বহু কিছুই বাকি থেকে যেত। রমজানের রোজা উম্মাহর ধ্বনিতে গঠনমূলক চিন্তা চেতনা ও ভ্রাতৃত্বময় আদর্শিক রক্ত প্রবাহের জন্য এক বিরাট নিয়ামক শক্তি। যে কোনো জাতির জন্যই এমন উপবাসব্রত ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদির কর্মসূচি অত্যাবশ্যক। তাই কুরআনুল করীমের বর্ণনা অনুযায়ী দেখা যায় পূর্ববর্তী সকল জাতির ওপরই সিয়ামের বিধান ছিল। আমরা যেন রোজার শিক্ষা ও আবেদনকে আত্মস্থ করতে পারি এদিকে সকলকে আন্তরিক হতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]