ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫, ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১

গণপিটুনি প্রতিরোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি

নাহিদুল ইসলাম গাজী

প্রকাশিত: ২০:২৮, ১৩ মার্চ ২০২৫

গণপিটুনি প্রতিরোধে আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি

চিলে কান নিয়েছে শুনে, কানে হাত না দিয়েই চিলের পেছনে ছুটে চলেন একদল অতিউৎসাহী মানুষ। বলছি গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যার মতো ভয়ানক অপরাধের কথা। সর্বশেষ, কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ডাকাতের গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে দুজনকে হত্যা করার খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। যা জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য খুবই লজ্জাজনক হৃদয়বিদারক ঘটনা।

এভাবে গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা করা দেশে নতুন কিছু নয়। গণপিটুনিতে বাংলাদেশে প্রতি বছর বহু সংখ্যক মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির হিসেবে, গত সাত মাসে সারাদেশে ১১৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৯ জনের মৃত্যু এবং ৭৪ জন আহত হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত দশ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছে কমপক্ষে ৭৯২ জন আহত হয়েছে ৭৬৫ জন।

এছাড়া ২০২৪ সালে দেশে গণপিটুনিতে মারা গেছেন ১৭৯ জন এবং আহত হয়েছেন ৮৮ জন। গত বছরের মতো গণপিটুনির ঘটনা দেশে সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল ২০১৫ ২০১৬ সালে। এইচআরএসএস এর তথ্য মতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি ফেব্রæয়ারি মাসে দেশে অন্তত ৩০টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ১৯ জন এবং আহত হয়েছে ২০ জন।

সন্ত্রাসবাদ ডাকাতির মত গণপিটুনিও একটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বাংলাদেশের আইনে নেই গণপিটুনি নামক অপরাধের কোনো সংজ্ঞা। নেই কোন সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান। নেই কোনো বিশেষ আইন। যার সুযোগ নেয় সুযোগসন্ধানীরা।

গণপিটুনি রোধে প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট আইনি বিধান এখন সময়ের দাবি। গণপিটুনি রোধের বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। গণপিটুনি প্রতিরোধে ২০১৯ সালে আদালতের দেওয়া দফা নির্দেশনা সবাই মিলে বাস্তবায়ন করতে পারলে গণপিটুনির মতো জঘন্যতম অপরাধ থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে আসা সম্ভব।

আদালতের দেওয়া গণপিটুনি রোধে দফা নির্দেশনাগুলো হলোÑ

. পুলিশের প্রত্যেক সার্কেল অফিসার তার অধীনের প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে ছয় মাসে অন্তত একবার গণপিটুনি প্রবনতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে বৈঠক করবেন।

. গণপিটুনির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার প্রচার কার্যক্রম গণমাধ্যমে প্রচারণা অব্যাহত রাখবে।

. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কোনো ধরনের অডিও, ভিডিও, মেসেজ যা গুজব সৃষ্টি বা গণপিটুনিতে মানুষকে উত্তেজিত করতে পারে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যে দুষ্কৃতকারীরা কাজে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

. যখনই গণপিটুনির মতো কোনো ঘটনা ঘটবে, কোনো রকম দেরি না করে তখনই থানার ওসি এফআইআর নিতে বাধ্য থাকবে এবং তা সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারকে অবহিত করবেন।

. গণপিটুনিতে (তৎকালীন ২০১৯ সালে গণপিটুনিতে নিহত) তাসলিমা বেগম হত্যার ঘটনায় ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার উত্তর বাড্ডা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অবহেলার ব্যাপারে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

এখানে পঞ্চম দফার নির্দেশনা ব্যতীত বাকি টি নির্দেশনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে প্রযোজ্য। যার ৩টি প্রতিরোধমূলক এবং ১টি প্রতিকারমূলক।

তৎকালীন ২০১৯ সালের আদালতের দেওয়া এই নির্দেশনাগুলো অন্তর্ভুক্ত করে গণপিটুনি সংক্রান্ত বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হলে গণপিটুনি প্রতিরোধ বিচার কার্যক্রম করা সম্ভব।

প্রতিবেশী দেশ ভারতেও অসংখ্য গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। ভারতের গণপিটুনির বিষয়ে ভারতীয় হাইকোর্টে করা রিটের প্রেক্ষিতে ভারতের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সদস্যের হাইকোর্ট বেঞ্চ জানায়, দেশের বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে রক্ষা করতে হবে। বিষয়টি শক্ত হাতে মোকাবিলার প্রেক্ষিতে দেশটির রাজ্যগুলোকে পৃথকভাবে গণপিটুনি আইন আনার পরামর্শ দেওয়া হয়। (সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা)

এই ধারাবাহিকতায় মৃত্যুদÐের বিধান রেখে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে গণপিটুনি রোধে, দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল (প্রিভেনশন অব লিঞ্চিং) বিল-২০১৯ নামে একটি বিল পাশ করানো হয়।

আমাদের দেশেও গণপিটুনি রোধে আদালতের দেওয়া নির্দেশনা অনুসারে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা জরুরি। গণপিটুনি রোধে হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে গণপিটুনি অপরাধের ভয়াবহ দিকগুলো তুলে ধরে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইনস্টিটিউট অব লাইভস্টক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি

 

×