
শস্য-শ্যামল সবুজ বাংলাদেশ আবহমান কালের উর্বর পলিমাটির বরেন্দ্র অঞ্চল। ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা শুধু সংগীতের মূর্ছনা নয়, নিরেট বাস্তবতায় তা এই অঞ্চলের এক অবারিত সম্পদও বটে। ভিনদেশী পরিব্রাজক আর স্বদেশী কবি-সাহিত্যিকদের বন্দনায় বঙ্গভূমির যে অনন্য শৌর্য সেটাও নিজস্ব সীমানার এক অনধিগম্য স্বাধীন চেতনার লড়াকু গোষ্ঠীর চিরায়ত বৈভব। ইতিহাস সাক্ষী বাংলা কখনো দিল্লির শাসকবর্গের ব্যবস্থাপনা থেকে দূর-দূরান্তে আপন সীমানায় থাকা গৌরবান্বিত এক অস্ট্রিক জাতি গোষ্ঠী। দিল্লির রাজন্যবর্গও কখনো বাংলাকে নিয়ে মাথা ঘামাননি। নির্দিষ্ট খাজনা আদায়ের বিনিময়ে যুগ-যুগান্তরের এক স্বাধীন সত্তায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো অস্ট্রিক জাতি গোষ্ঠীর আপন উদ্ধত বাতাবরণ। ব্রিটিশরাই প্রথম জাতি যারা আবহমান বাঙালি সভ্যতার ওপর নিজেদের কৃষ্টি সংস্কৃতি নিয়ে প্রভাব বিস্তারে আগাতে থাকে। ব্রিটিশ শাসনের করাল নিষ্পেষণ আর সম্পদ পাচারের যে দুর্বিষহ বিষয় তাও এই বরেন্দ্র অঞ্চলের রিক্ত, তিক্ত ইতিহাস। খোদ ইংরেজ ঐতিহাসিকরাও বলেন ১৭৫৭ সালে ক্লাইভের হাতে বাংলার পতন না হলে ১৭৬০ সালে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব হতো কি না যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব হয় ১৭৬০ সালে আর বাংলায় মহামন্বত্বর হয় ১৭৬৯ সালে। যা ইতিহাসেও লিপিবদ্ধ আছে বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ’৭৬-এর মনন্বত্বর হিসেবে। যাতে ১/৩ লোক অনাহারে-অর্ধাহারে দুর্ভিক্ষে মারা যায়। সেই সম্পদশালী বাংলা উপমহাদেশীয় বলয়ের চরম কোপানলে আরও দুইশত বছর শাসন শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন পাক-ভারতকে মুক্ত, স্বাধীন করে দেয় সেই বাংলার পূর্বাংশ পাকিস্তানের আওতায় চলে আসে। সেই পাকিস্তানি শাসনামলেও কোনোভাবে সুস্থির আর স্বস্তিদায়ক ছিলই না।
ভাষার প্রশ্নে চিরায়ত কৃষ্টি সংস্কৃতির ওপর চরম আঘাত হানার পরিণামে বাঙালিরা আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালে দেশের যথার্থ স্বাধীনতাকে সর্বমানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। তারপর বাঙালির গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলা। বাংলার আপামর জনগোষ্ঠীর যে লড়াকু অভিগমন শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানোর যে বলিষ্ঠ সংগ্রামী প্রত্যয় তাও নতুন করে জেগে ওঠা এই বরেন্দ্র অঞ্চলেরই নিয়ামক শক্তি। বাংলা যে দীর্ঘমেয়াদি কারও বশ্যতা স্বীকার করেনি তা নতুন করে আবার জাগিয়ে তুলল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। নির্বাচনের নামে ছলচাতুরি করে দীর্ঘ ১৬ বছর পতিত সরকার শেখ হাসিনার যে লাগাতার দুঃশাসন সেটাও ক্রমান্বয়ে ধ্বসে পড়া ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। শাসন, শোষণ আর চরম অনিয়ম, বিশৃঙ্খলায় ভেতরের সর্বশক্তি কেমন যেন অপশক্তিতে রূপ নেওয়া তাও তো কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। আবার এমন অপশক্তিকে রুখতে ভেতরের বোধ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজের যে সহজাত ঐতিহাসিক আন্দোলন পরিক্রমা সেটা নতুন বাংলাদেশের অভাবনীয় প্রাপ্তি। আবারও প্রমাণ হলো লাগাতার কোনো অপশাসন, দুর্বৃত্তায়ন, অধিকার হরণ, স্বাধীন সত্তায় আঁচ লাগানো কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়ই না। আভ্যন্তরীণ আনাচে-কানাচে জনরোষ ফুঁসতে থাকে। বাহ্যিক অবকাঠামোর নান্দনিক শৌর্যের মধ্যে সার্বিক জনগোষ্ঠীকে শাসন শোষণের অপঘাতে যে বৈপ্লবিক মনস্তত্ত্ব তাও খুব বেশি দিন পাদ-প্রদীপের আড়ালে থাকাও অসম্ভবের পর্যায়ে চলে যায়। আর সেখান থেকেই ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নব সূর্যোদয় জাতির জন্য কাক্সিক্ষতই শুধু নয় বরং বড় বেশি প্রয়োজনও ছিল। যা ইতিহাস ও সমাজ সভ্যতার নিয়মানুগই হয়েছে। নতুন কিছু নয় চিরস্থায়ী এক শাসন-শোষণের অবশ্যম্ভাবী চরম পরিণতি।
২০২৪ এর জুলাইয়ের নব যাত্রার ইতিহাসও অত সহজসাধ্য ছিলই না। বরং দীর্ঘ শাসন মেয়াদের নিয়ত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে কত যে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাও আর এক মুক্তির নতুন লড়াই তো বটেই। ততদিনে কত মায়ের বুক খালি হয়েছে কত পিতা সন্তান মৃত্যুর যন্ত্রণায় কাতরিয়ে ভেঙে পড়েছেন তাও বাঙালি ইতিহাসের আর এক রক্তাক্ত দলিল। এমন সব জঘন্য হত্যা আর নিয়ত কালো অধ্যায় আরও আঁধার করে দিতে জাতিকে চরম বিপন্নতার সম্মুখ সমরে দাঁড় করায়। সেখান থেকেও মুক্তি পাওয়া এত সহজসাধ্য বিষয়ই নয়। কারণ স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। কিন্তু বিদায়ী সরকারের হরেক অপসংস্কার, জঞ্জাল, কঠিন দুঃশাসন কাঠামোর অভ্যন্তরে জিইয়ে থাকাও ইতিহাসের নির্মম বিধি। সেখান থেকে সচেতন সাবধানতায় পার হতে গেলে সামনের চলার পথকে আর নিঃশঙ্ক আর নির্বিঘ্ন করা যেন ইতিহাসেরই দায়বদ্ধতা। এখন দেশ শাসন করছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখাই শুধু নয় দেশকে স্থিতিশীল অবস্থায় নতুন তৈরি করে দেওয়াও বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। অভ্যন্তরীণ অপসংস্কার যা দীর্ঘমেয়াদি শাসনামলের লাগাতার ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা অঞ্চলভিত্তিক নেতৃত্বের দাপট আর হুঙ্কারে অতি সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় যে অনাকাক্সিক্ষত প্রভাব প্রতিপত্তি সেটা জাতির জীবনের কোনো আইনানুগ ব্যবস্থাপনা তো নয়। দীর্ঘ ১৬টা বছর বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেছে। বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ কিংবা ফলপ্রসূ প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হতে অপেক্ষার প্রহর কেটেছে। সমাধানের উপায় দূর অস্ত ধরা ছোঁয়ারই বাইরে। তবে বর্তমান সরকার নির্বাচনকে নিয়ে ভাবছে। নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরিতে কিছু সময় লাগাও বাঞ্ছনীয়। তড়িঘড়ি করলে পুরানো পতিত সরকারের হরেক জমাটবদ্ধ জঞ্জাল আগামীর বাংলাদেশকে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে বারবার পিছু হটাবে। তবে কোনোভাবেই আর পুরানো ভুল ভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবেই না। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আপন গতিতে নতুন রাষ্ট্র গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকায় এগিয়ে যেতে যা যা করণীয় সবটাই করা জরুরি এবং অত্যাবশ্যক। রাজনীতি, নির্বাচন, ভোট, জনগোষ্ঠীর সচেতন স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সবই যেন বিনি সুতার গাঁথামালা। বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোনো সুযোগই নেই। সঙ্গতকারণে সমন্বয়হীনতাও সমূহ বিপদ ডাকতে দেরি করবে না। এমনিতেই বহু আপদ, সমস্যা, হরেক যন্ত্রণা মোকাবিলা করে পুরো জাতির এখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। সময়সাপেক্ষ যে কোনো বিষয়ের জন্য ধৈর্য ধারণ করা প্রচলিত নিয়ম-নীতিকে মান্যতা দেওয়া। যদিও আমরা এখন অনেক অস্থির আর দোলাচলে দিন পার করছি। হরেক বিপরীত প্রতিবেশ পদে পদে আঘাত হানছে। পতিত সরকার প্রধান দেশ ছাড়লেও তার কুশীলবের সিংহভাগই দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পরাজয়ের গ্লানি তারাও মেনে নিতে পারেননি। প্রতিশোধের উন্মত্ততায় সেখানে বেসামাল পরিস্থিতি তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। তাই সতর্ক আর বিচক্ষণতায় দীর্ঘদিনের জঞ্জাল অপসারণ করতে অপেক্ষার প্রহরও গুনতে হবে। যাতে পুরানো সরকারের ছাপ নতুন বাংলাদেশ গঠন প্রক্রিয়ায় বাধা বিঘ্ন তৈরি করতে না পারে। আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো স্বাধীন সত্তায় বেঁচে থাকার এক অদম্য লড়াকু অস্ট্রিক জাতি গোষ্ঠী। সামনেও তার যথাযথ প্রমাণ দিতেই ধৈর্য, সহ্য আর দেশাত্ম বোধের অপার সম্মোহনে।