
ছবি: প্রতীকী
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা প্রদান করেন। তার বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের নারীদের জন্য লিঙ্গ সমতা, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তারেক রহমান তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনজন নারী—তার মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান এবং তার কন্যা জাইমা রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
তিনি বলেন, “আমি সবসময় চেয়েছি, তারা যেন সব ধরনের সুযোগ, সাফল্য ও সুখ লাভ করেন।” এই ব্যক্তিগত অনুভূতি আসলে বাংলাদেশের প্রতিটি নারীর জন্য তার স্বপ্নেরই প্রতিফলন। তিনি বিশ্বাস করেন, নারীদের ক্ষমতায়িত ও সমর্থিত করা প্রতিটি সমাজের নৈতিক দায়িত্ব।
তারেক রহমান তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নারীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় স্থাপন করেন এবং নারী কর্মসংস্থানের নতুন নতুন দ্বার উন্মুক্ত করেন। গার্মেন্টস শিল্পের সূচনা করে নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ প্রশস্ত করেন।
বেগম খালেদা জিয়ার সরকার নারী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে অবৈতনিক মাধ্যমিক শিক্ষা চালু করে, নারীদের উপর ঘটিত অত্যাচার নির্যাতনের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এবং ধর্ষণ ও অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। এছাড়া, স্থানীয় সরকারে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করে।
নারীদের প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে তারেক রহমান বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। তারেক রহমান ঘোষিত বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচির মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত দফাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নারীরা যাতে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন, যাতে তারা কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাক্ষেত্রে হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার না হন, সে বিষয়ে তারেক রহমান অত্যন্ত সচেতন। তিনি বলেছেন, “আমাদের কন্যাদের ছেলেদের সমান সুযোগ পাওয়া উচিত; তারা যেন ভয় ছাড়াই ঘরের বাইরে যেতে পারে, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে, এবং তাদের কণ্ঠকে দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করতে পারে।”
নারীদের প্রতি সহিংসতা দূর করতে তারেক রহমান কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, শুধু আইন প্রয়োগ করলেই হবে না, বরং সামগ্রিকভাবে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। নারীদের আত্মনির্ভরশীল করতে বিএনপির নীতিগুলো নারীর অপার সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে।
ফ্যামিলি কার্ড: তারেক রহমান প্রতিটি পরিবারের জন্য ‘ফ্যামিলি কার্ড’ চালুর ঘোষণা দিয়েছেন, যা পরিবারের নারী অভিভাবকের নামে ইস্যু করা হবে। এর মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে, যা নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এসএমই ঋণ: স্বাবলম্বী নারী উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।
কন্যা শিক্ষার জন্য অ্যাকাডেমিক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ: কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে কন্যা শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কারিগরি ও অ্যাকাডেমিক প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো হবে।
তারেক রহমান ঘোষিত বিএনপির ৩১ দফার ২৩ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। নারী ও শিশুদের জীবনমান বিকাশের জন্য যুগোপযোগী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে নারীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এই দফাটি নারীর ক্ষমতায়ন ও সমাজে তাদের অবস্থান সুসংহত করার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উন্নয়নের অপরিহার্য অংশ। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও তা এখনও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি। বিশেষ করে রাজনীতি, প্রশাসন ও অর্থনৈতিক খাতে নারীরা বিভিন্ন সামাজিক ও কাঠামোগত বাধার সম্মুখীন হন।
বিএনপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তারা ক্ষমতায় গেলে নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ করবে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নারীদের অন্তর্ভুক্তির মতো পদক্ষেপ থাকতে পারে।
নারী ও শিশুদের জীবনমান উন্নয়ন একটি টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। বর্তমান বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়ন এবং শিশুর সার্বিক কল্যাণকে উন্নয়নের অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিএনপি যুগোপযোগী উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার মাধ্যমে নারীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। শিশুর সুস্থ বিকাশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শিক্ষা, পুষ্টি, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা এবং সহিংসতা প্রতিরোধের ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে বলে আশা করা যায়।
জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য নীতিগতভাবে প্রাধান্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ক্রমাগত বাড়লেও সংসদীয় রাজনীতিতে তাদের সংখ্যা এখনও তুলনামূলকভাবে কম। বিশেষ করে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে নির্বাচিত নারীর সংখ্যা সীমিত। বিএনপি যদি মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় নারীদের জন্য নীতিগত অগ্রাধিকার নিশ্চিত করে, তাহলে নারীরা জাতীয় রাজনীতিতে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে এবং নীতি প্রণয়নে সরাসরি অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। স্থানীয় সরকার হলো জনগণের সবচেয়ে কাছের প্রশাসনিক কাঠামো, যেখানে নারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে স্থানীয় পর্যায়ে তাদের সমস্যা ও চাহিদাগুলো আরও কার্যকরভাবে সমাধান করা সম্ভব হবে। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও কার্যকর নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। বিএনপি এই দফায় নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় প্রশাসনে নারীরা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে।
তারেক রহমানের বার্তা শুধু একটি রাজনৈতিক ঘোষণা নয়, এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্য আহ্বান। তিনি নারীদের সুরক্ষা, মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের জন্য যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা কেবল রাজনৈতিক বিবৃতি নয়, বরং এটি একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর অধিকার সুরক্ষিত করা সম্ভব।
নারীর ক্ষমতায়নে বিএনপির দীর্ঘদিনের ভূমিকা ও প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি নারীদের জন্য একটি নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও সমান সুযোগ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
নারী দিবসে তারেক রহমানের দেওয়া বার্তা আমাদের সকলকে অনুপ্রাণিত করে, যাতে আমরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটি উন্নত, নিরাপদ ও সাম্যতাভিত্তিক সমাজ গঠনে একসঙ্গে কাজ করতে পারি।
লেখক, মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
সাবরিনা/শহীদ