ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১

দেশের প্রাণ ধান পান গান

গোরা বিশ্বাস

প্রকাশিত: ১৯:৪০, ১২ মার্চ ২০২৫

দেশের প্রাণ ধান পান গান

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের উৎপাদিত খাদ্যশস্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফসল হচ্ছে ধান, ভুট্টা, গম। এর মধ্যে ধানই হচ্ছে প্রধান, যা না হলে বাঙালিদের বেঁচে থাকাই কষ্টকর। বঙ্গোপসাগরের পলি বিধৌত এদেশের মাটি খুবই উর্বর। এক সময় দেশের প্রতিটি অঞ্চল বর্ষার পানিতে প্লাবিত হতো। বন্যার পানি ফসলি জমিতে প্রবেশের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি বেড়ে যেত এবং ধান উৎপাদনের জন্য ছিল খুবই উপযোগী। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও আমাদের দেশে সাধারণত আউশ, আমন, বোরো ও শাইল ধান কৃষকদের গোলায় উঠত। তখন বিঘাপ্রতি এলাকাভেদে ৮-১০ মণ ধানের বেশি হতো না। কোনো কোনো সময় অতি খরা, অতি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কৃষকের মাথায় হাত পড়ত। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের পক্ষে সারাবছর খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই ছিল প্রাণান্তকর। সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে গাজীপুরে ১৯৭৩ সালে ধান উৎপাদন গবেষণা কেন্দ্র (ইজজও) ও ঢাকার খামার বাড়িতে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (ইঅজঈ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করে দেশ ধান উৎপাদনে প্রায় শীর্ষে পৌঁছে যায়। উচ্চ ফলনশীল ইরি ও ব্রি-৭২ এবং ব্রি-৭৩ জাতের ধানের উৎপাদন আগের চেয়ে অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জাতের ধান বিঘাপ্রতি ৩০-৪০ মণ পর্যন্ত ফলন দিচ্ছে। ধান চাষের পাশাপাশি গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারপরেও ভাতই যেহেতু আমাদের প্রধান খাদ্য, তাই ধানের কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমানে বাজারে যে সকল চাল পাওয়া যায়, তা থেকে যে ভাত হয়, তাতে যে পরিমাণ পুষ্টি ও অন্যান্য উপাদান থাকার কথা, তা নেই। সে কারণে মানুষের দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। সম্প্রতি উন্নত জাতের জিংকসমৃদ্ধ ব্রি জাতের ধান কৃষকরা চাষ করছে। এ ধানের চাল থেকে যে ভাত হবে, তাতে মানুষের জিংকের অভাব অনেকটা পূরণ হবে বলে গবেষকরা মনে করেন। বাজারে জিংকসমৃদ্ধ চালের সরবরাহ বাড়াতে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের এ ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ব্রি এর মধ্যে রয়েছে ব্রি, বোরো ও আমন। এর ফলন জাতভেদে হেক্টর প্রতি ৫-৮ মন পর্যন্ত হয়ে থাকে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে, ধানের  উৎপাদন বাড়াতে হবে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ধানের ব্যবহারিক দিক ছাড়াও ধান নিয়ে গান, কবিতা ও ছড়া রচিত হয়েছে অনেক। এবার ধানের পর রসালো পানের রস নিয়ে কিঞ্চিত রস আস্বাদন করা যাক।
পান শুধু অর্থকরী ফসলই নয়, পান বাংলার লোকসাহিত্যের একটি অংশজুড়ে আছে। পান নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য ছড়া, কবিতা ও গান। এর মধ্যে শেফালী ঘোষের অতি জনপ্রিয় একটি গানÑ ‘যদি সুন্দর একটি মন পাইতাম, সদরঘাটের পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম’। আরও একটি গানে আছে- ‘পাগলিনী হইলাম আমি পান-সুপারি খাইয়া’। শিশুদের জন্য- ‘বাটাভরা পান দেব, কালো গরুর দুধ দেব’ এরকম অসংখ্য ছড়া-গান রচিত হয়েছে পান নিয়ে। এবার পানের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিয়ে সম্যক আলোচনা করা যাক। আগের দিনে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই বাণিজ্যিক না হলেও পরিবারে ব্যবহারের জন্য বড় কোনো একটি গাছের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পান লতা লাগানো হতো। ঐ গাছের ওপর ধীরে ধীরে পান গাছ ছড়িয়ে পড়ত। সেখান থেকে বছরব্যাপী একটি পরিবারের পানের চাহিদা মিটত।  পানগুলো আকারে ছোট হলেও খেতে ছিল সুস্বাদু। এখন আর সেরকমভাবে গৃহস্থ বাড়িতে পানের গাছ চোখে পড়ে না। আধুনিক প্রযুক্তিতে বাণিজ্যিকভাবে এখন পানের চাষ হচ্ছে। এই পান আকারে বড়, স্বাদ-গন্ধে অনেকটা আলাদা। বাংলাদেশে পান চাষের জন্য বিখ্যাত বরিশাল, বরগুনা অঞ্চল। এরপর লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী অঞ্চলেও পানের চাষ গড়ে উঠেছে। উপজেলা কৃষি অফিসের এক তথ্যে জানা যায়, এ বছর তিন হাজার ছয়শ’ টন পান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পান গাছ এক শ্রেণির লতানো জাতীয় উদ্ভিদ। এই গাছ ১০-১৫ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। এর বৈজ্ঞানিক নাম বিটল পিপার, দেশীয় নাম পান। সবুজ রঙের চিকন ডোরাকাটা পাতা। পানগাছ একটি দীর্ঘজীবী উদ্ভিদ। ১০ বছর পর্যন্ত পানের বরজ টিকে থাকে। এই গাছে রোগ-বালাইয়ের পরিমাণ কম বিধায় সহজেই চাষ করা যায়। পানের উপকারিতা ও ব্যবহার সম্পর্কে কিছু জানা দরকার। পান আমাদের ধানের মতোই নিত্যসঙ্গী। বিয়ে বাড়ি, যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে, অতিথি আপ্যায়নে পানের জুড়ি নেই। খাওয়ার পর পানের অভ্যাস অনেকেরই আছে। এদেশে হাট-বাজারে, যে কোনো ছোট দোকানপাটে আর কিছু না হোক, এক খিলি পান পাওয়া যায়। একটি পানের দাম বর্তমানে ৫-২০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। পান বিপণনের ক্ষেত্রে শুধু দেশীয় বাজারই নয়, বিদেশেও হচ্ছে পান রপ্তানি। এছাড়াও পানে রয়েছে ঔষধি গুণ। ক্ষুধা, হজমশক্তি বৃদ্ধি ও পাকস্থলীর রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে। প্রচলিত প্রবাদে আছে, ‘পানে করে শালসার গুণ, যদি না খাও সুপারি চুন’। পান ইউনানী, হারবাল ওষুধ প্রস্তুতের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নিয়মিত পানের রস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
সংগীতকে ভালোবাসে না এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। একটি ভালো সংগীত শত শোক-দুঃখে, রোগ-ব্যাধির মাঝেও মানুষের মনকে উৎফুল্ল করে রাখে। একটি শুদ্ধ সংগীত এর জন্য অসুস্থ ব্যক্তিকেও সুস্থ করে তুলতে পারে। প্রতিটি মানুষই জন্মগতভাবে গায়ক। কোনো নির্জন স্থানে বা একাকিত্বে সুখ-দুঃখের সময় গুনগুন করে সকলেই আমরা গান গেয়ে থাকি। গান মানুষের মন ও হৃদয়কে প্রশান্তির দিকে নিয়ে যাওয়ার একটি মাধ্যম। মরমি ও সহজিয়া সাধকরা এ গানের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। স্রষ্টার সান্নিধ্য পেতে তারা প্রচুর মরমি ও দেহতাত্মিক গান রচনা করেছেন। পাশাপাশি পঞ্চকবির গানগুলো তো রয়েছেই। এছাড়া পল্লীগীতি, লোকগীতি, ভাওয়াইয়া, টপ্পা, গম্ভীরা ও গজল সংগীতের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় একটি গানে এদেশকে শুধু গানের দেশ বলে উল্লেখ করেছেন। এদেশের খেত-খামারে সোনালি ধানের শোভা, সবুজ পানের হাতছানি, গাঁয়ের মেঠোপথে রাখালের মনকাড়া গানের সুর- সেরকম কিছু তুলে ধরাই এ লেখার উদ্দেশ্য। পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া গানগুলো সংস্কৃতির ঐতিহ্যের একটি অংশ। এর মধ্যে শিকড়ের সন্ধান মেলে। গ্রাম-গঞ্জের মানুষের যাপিত জীবনের চিরায়ত রূপ ও প্রতিচ্ছবি গানের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। মা-মাটি নিয়ে অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান রচিত হয়েছে আমাদের সাহিত্যে। কানাইলাল শীল ও রাধারমণের রচিত ভালোবাসা ও বিরহ-বিচ্ছেদের গান আজও আমাদের মনকে স্পর্শ করে। মানুষের মুখে গানগুলো আজও গীত হচ্ছে। যতদিন মানুষ ও সমাজ টিকে থাকবে, ততদিন গানগুলো বেঁচে থাকবে আমাদের মধ্যে। সকল হিংসা-বিদ্বেষ পরিত্যাগ করে সকলের মিলনে সম্প্রীতির বন্ধনে, ধানে-পানে আর সুমধুর গানের তানে আমাদের দেশ আমরাই গড়ব। সত্য, সুন্দর ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আমরাই লড়াই করব।
লেখক : সমাজকর্মী

×