
দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, গোটা বিশ্বেই বাংলাদেশের কর-জিডিপি হার নিম্নতম পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশের এই হার প্রতিবেশী দেশ নেপালের অর্ধেকের চেয়ে কম। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের অবস্থাও এদিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের চেয়ে কম কর-জিডিপি অনুপাত শুধু দারিদ্র্যপীড়িত বা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোয় রয়েছে। দেশের এ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন অনেকে। অর্থনীতিতে গতি ফেরানোর জন্য নানা পদক্ষেপের পরেও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। শুধু ঘাটতি নয়, অর্থবছরের অর্ধেক সময় পার হলেও দেখা যায়, এ সময়ে রাজস্ব আহরণ গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৩৩৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। পুরো অর্থবছরের জন্য এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয় ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছিল এক লাখ ৫৭ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় এক হাজার ৫৪২ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে; যা দশমিক ৯৮ শতাংশ কম। ২০২৪ সালের জুনে বাজেট ঘোষণার পর মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, রিজার্ভের পতনসহ অর্থনীতিতে নানা সংকট শুরু হয়। সে বছর জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং এর ধারাবাহিকতায় আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। আন্দোলনের ধাক্কা ও সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার প্রেক্ষাপটে আমদানি, রপ্তানি ও উৎপাদনসহ অর্থনীতির সকল সূচক মন্থর হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণ কমার ধারাও অব্যাহত থাকে।
হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরে গত বছরের এ সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় দেখেছে ক্ষমতার পালাবদলের মাস আগস্ট। কর আহরণ বাড়াতে হলে কর ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে। ঢেলে সাজাতে হবে কর প্রশাসনকে। নিয়ে যেতে হবে আয়-বর্ধিষ্ণু এলাকাগুলোর কাছাকাছি। কর আহরণে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করতে হবে। এ খাতের দুর্নীতি কমিয়ে আনতেও শক্ত পদক্ষেপ কাম্য। বিদ্যমান ব্রিটিশ পদ্ধতিতে কর আদায় অব্যাহত থাকলে কর আহরণে সুফল দেবে না। ইতোমধ্যে গৃহীত রিরা (রিফর্মিং ইন্টারনাল রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এবং ট্যাক্টস (ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অ্যান্ড ট্যাক্স পেয়ারস সার্ভিসেস) প্রকল্পগুলো বেশ কাজ দিয়েছে। এ ধরনের আরও উপযোগী প্রকল্প গ্রহণে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তাও মিলতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের জিডিপি অনুপাতে কর ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়লে গড়ে অতিরিক্ত ৬৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে। এ বাড়তি রাজস্ব বিভিন্ন খাতে সরকার বিনিয়োগ করলে তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়াবে। ২০২২ সালের হাউসহোল্ড ইনকাম-এক্সপেনডিচার সার্ভে অনুসারে দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৪১ দশমিক ১০ শতাংশ ধনীর হাতে আর মোট ৩০ শতাংশ সম্পদ ওপরের স্তরের ৫ শতাংশের হাতে রয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে যথাযথ কর আদায় করতে পারলে এর চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব বাড়বে। আয়বৈষম্যও কমে আসবে। জিনি কোইফিশিয়েন্টের (আয়বৈষম্য নির্ধারণের পদ্ধতি) হিসাবে দেশে বৈষম্য ১৯৯০ সালে শূন্য দশমিক ৩৫ ছিল, তা এখন শূন্য দশমিক ৪৯-এ এসে গেছে। অর্থাৎ আয়বৈষম্য বেড়ে গেছে। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের দারিদ্র্য হয়তো সুনির্দিষ্ট হারে কমেছে। কিন্তু অর্থনীতির গতির সঙ্গে সমন্বয় করে রাজস্ব আদায় বাড়েনি।
আমাদের কর-ডিজিপির হার বাড়াতে হলে কর ফাঁকি দেওয়া ঠেকাতে হবে। অন্যদিকে আবার আইএমএফের কথামতো সেচের পানি, ডিজেল ইত্যাদির ওপর হরেদরে কর বাড়ানোও যাবে না। তবে এটাও হয়তো ঠিক, অনেক দিন ধরে চলে আসা, এমনকি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর কিছু একপেশে ও ব্যক্তিগত অনুরোধ ও উপরোধে চলে আসা কর-রেয়াত বা অব্যাহতির বিষয়টি আমাদের গভীর বিবেচনায় নিতে হবে।
সম্প্রতি আইএমএফ বাংলাদেশকে কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। আইএমএফের চিরাচরিত তিনটি নীতি আছে। প্রথমত, নমনীয় বিনিময় হার, দ্বিতীয়ত, নমনীয় ও উচ্চ সুদহার এবং তৃতীয়ত, কঠোর মুদ্রানীতি। এরা অনেকটা আপ্তবাক্যের মতো তিনটি নীতি অনুসরণ করতে বলে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনটিই অ্যাডাম স্মিথ বর্ণিত অদৃশ্য হাত (ইনভিজিবল হ্যান্ড), যেন সব কাজ করে ফেলবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর বাইরে অনেক বিষয় আছে। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে দেশকে গৎবাঁধা নীতির বাইরেও যেতে হবে। সে জন্য অতীতের মতো রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন গঠনের কথাও ভাবা যেতে পারে। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে, নাকি পরোক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ করা হবে, এ ব্যাপারে অনেক আলোচনা আছে। এদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলে আমদানি শুল্কও কমবে। এতে আমাদের আমদানি রাজস্বও কমবে। এর প্রভাব পড়বে শিল্পোৎপাদনেও। অর্থাৎ হঠাৎ মুদ্রানীতির মাধ্যমে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। ব্যাংকাররা তাঁদের ঋণ দিতে চান না কিংবা ঋণ না দেওয়ার জন্য নানা বাহানা তৈরি করেন। বড় ব্যবসায়ীদের ওপর অবশ্য এর প্রভাব খুব একটা পড়ে না। বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ পান, কারণ তাঁরা হয়তো তথাকথিত জামানত দিতে পারেন। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর মনোনিবেশ করতে হবে। বাজারে চাহিদা বেড়ে গেলে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে হবে। সেজন্য হয়তো মাঝেমধ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের হাতে যেন ঋণ পৌঁছায়, সে জন্যও বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে আর্থিক হিসাব নেতিবাচক। তবে চলতি হিসাব ইতিবাচক। আর্থিক হিসাব নেতিবাচক মানে অধিক হারে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে হলে বিনিয়োগ খাতকে আকর্ষণীয় করতে হবে। বিনিয়োগ আকর্ষণে জটিলতা নিরসন করে দেশীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোয় উদ্যোগ নিতে হবে। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে। কর্মসংস্থান বাড়লে বেকারত্ব কমবে। রেমিটেন্সও কম এবং তা বাড়ানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়াতে হলে হুন্ডি কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। হুন্ডি কমানোর জন্য কিন্তু অনেক আইনকানুন আছে। হুন্ডি একেবারে নির্মূল করা কঠিন হলেও কমানো অবশ্যই সম্ভব।
দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। ক্রমবর্ধমান ঋণের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার উপায় বের করতে হবে। আইএমএফ এবং অন্যান্য সংস্থা থেকে যেসব ঋণ নেওয়া হচ্ছে তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের জনগণকে ঋণের বোঝা বইতে হবে। বাংলাদেশের অবস্থা হয়তো খুব শোচনীয় নয়। তবে আমাদের বহুমুখী ঋণদান সংস্থার চাপ মোকাবিলায় রাজস্ব আহরণ যে বাড়াতে হবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। উন্নয়ন অর্থায়নের জন্যও এর বিকল্প নেই। স্থানীয়ভাবে রাজস্ব আদায়ের পথে তাই আনতে হবে অপরাপর দেশের অভিজ্ঞতার অভিনবত্ব। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, কর ব্যবস্থায় পরিবর্তন না আনতে পারলে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব নয়।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন