ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১

নিরাপদ শৈশব চাই

খন্দকার আপন হোসাইন

প্রকাশিত: ১৭:২৭, ১২ মার্চ ২০২৫

নিরাপদ শৈশব চাই

শৈশব মানে নিষ্পাপ হাসি। শৈশব মানে দৌড়ে বেড়ানো। শৈশব মানে রঙিন স্বপ্ন দেখা। কিন্তু ভয়াবহ এক বাস্তবতা শৈশবের ওপরও নেমে এসেছে। মাগুরায় আট বছর বয়সী শিশু আছিয়া ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তার অপরাধ কী? সে শিশু? সে মেয়ে? নাকি এই সমাজে জন্ম নেওয়া এক অভিশাপ? মাগুরার আকাশ এখন অন্ধকারে ভরা। কন্টকের মতো বিঁধে আছে চারপাশের নিঃশব্দতা। আট বছরের একটি শিশুর দেহে নির্মমতার ছায়া পড়েছে। তার কণ্ঠে জমে থাকা চিৎকার এখনো ধ্বনিত হচ্ছে নির্জন গলির মেঝেতে। অন্ধ গহ্বরে ঘটে যাওয়া বীভৎসতা সমাজের বুকে এক গভীর ক্ষতের জন্ম দিয়েছে। মায়ের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা অভিযোগের বাক্যগুলো ছুরির ফলার মতো খোদাই হয়ে গেছে ন্যায়বিচারের দরজায়। ধর্ষণের পর হত্যাচেষ্টা। ভুক্তভোগী এক অবুঝ শিশু। অপরাধী নিতান্ত প্রিয়জন। বলতে গেলে একই পরিবারের সদস্য। এই সমীকরণে মানবতার সকল সমার্থক শব্দ হারিয়ে যায়। শিশুটির বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুর আত্মার সম্পর্কের জালে জড়িয়ে থাকা চারটি নাম এখন নিষ্ঠুরতার প্রতিশব্দ। মেঝেতে পড়ে থাকা শিশুটির দিকে তাকিয়ে বোনের চোখে ঘুমের ঘোর। সে ভেবেছে, হয়তো স্বপ্নের ভেতর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে শিশুটি। কিন্তু বাস্তবতা ছিল তার চেয়েও ভয়ংকর।
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের আঙিনায় লুকিয়ে থাকা এই নির্মমতা নতুন নয়। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসাক) এর তথ্যমতে ২০২৩ সালে দেশে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ১,৪০০। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ১৭০০ এ উন্নীত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই আবার ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। অংক কষলে দেখা যায় প্রতি ১২ ঘণ্টায় একজন কন্যাশিশু যৌন সহিংসতার মুখোমুখি হয়। বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র প্রতিনিয়ত আমাদের হতবাক করে। শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের বহু দেশেই শিশু ধর্ষণ বেড়েছে। ইউনিসেফের তথ্যমতে বিশ্বে প্রতি পাঁচজনে একজন মেয়ে শিশুর শৈশবে যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের জরিপ অনুযায়ী ৬৮ শতাংশ শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আত্মীয়ের বাসায়। মামলার এজাহারে উল্লিখিত ‘অনৈতিক প্রস্তাব’-এর ইতিহাস সামাজিক ব্যাধির দিকে ইঙ্গিত করে। শিশু আছিয়ার বোনের বিয়ের পর থেকেই শ্বশুরের কুদৃষ্টি। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জানা সত্ত্বেও নীরবতা। এই নীরবতাই তো সমাজের আসল অপরাধ। ভার্জিনিয়া উল্ফ মনে করেন, “শত্রুর চেয়ে নিরপেক্ষতার মুখোশ পরা আত্মীয়রা অধিক ভয়ংকর।” আন্তর্জাতিক পরিসরে শিশু ধর্ষণের পরিসংখ্যান হৃদয়বিদারক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের ১২ কোটি মেয়েশিশু যৌন সহিংসতার শিকার।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন কঠোর। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুকে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তারপরও কেন কমছে না অপরাধ? কেন আট বছরের শিশুকে নির্মমতার শিকার হতে হয়? সমস্যার মূল কোথায়? সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিকতা হারিয়ে ফেলা মানুষ নাকি বিচারহীনতার সংস্কৃতি? অপরাধীরা জানে তারা ধরা পড়বে না। ধরা পড়লেও শক্তিশালী কেউ এসে রক্ষা করবে। ২০২১ সালে প্রকাশিত ব্র্যাকের গবেষণা দেখায় বাংলাদেশে ধর্ষণের ৯০ শতাংশ ঘটনার বিচার হয় না। অপরাধীরা ক্ষমতার ছায়ায় রয়ে যায়। শিশুরা রক্ষা পাবে কীভাবে? পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রÑ তিনটি স্তরে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পরিবারে নৈতিক শিক্ষার বুনিয়াদ গড়তে হবে। শিশুকে শেখাতে হবে, কী ভুল, কী সঠিক। স্কুলে যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। উন্নত বিশ্বে ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ শেখানো হয় ছোটবেলা থেকেই। বাংলাদেশেও এমন শিক্ষা জরুরি। রাষ্ট্রকে কঠোর হতে হবে। কেবল আইন থাকলেই হবে না, তার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণের বিচার দ্রুত শেষ করতে হবে। ২০২২ সালে দিল্লিতে একটি শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মাত্র ৩৪ দিনে বিচার শেষ হয়েছিল। বাংলাদেশেও এমন ব্যবস্থা দরকার। সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ যথেষ্ট নয়। শুধু ‘জাস্টিস ফর আছিয়া’ লিখলে সমাধান আসবে না। সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষকের পরিচয় গোপন না রেখে তাকে সমাজচ্যুত করতে হবে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য বলছে, ধর্ষণের শিকার ৭২ শতাংশ শিশু পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভোগে। তাদের ৩৪ শতাংশ আত্মহত্যার চিন্তা করে। প্রতিটি ধর্ষিত শিশুর আর্তনাদ আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। কিন্তু আমরা কি বদলাচ্ছি? নাকি সামনের দিনে আরও কোনো আট বছরের শিশুর রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখব? আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই। নয়তো শিশুর শৈশব হবে অনিরাপদ, মায়ের বুক ভাসবে চোখের পানিতে আর আমরা শুধু লজ্জিত হওয়ার অভিনয় করবো। আইনের বলয়ে এই মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(৪)/৩০ ধারায় দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ব্যবস্থায় শিশু মামলার গতি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, শিশু ধর্ষণ মামলার ৮৭ শতাংশ এখনো বিচারাধীন। গড় নিষ্পত্তি সময় ৫-৭ বছর। এই সময়সীমা একটি শিশুর সমগ্র শৈশবকে গ্রাস করে নেয়।

শিশু আছিয়ার মায়ের এজাহারে উঠে এসেছে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ। শাশুড়ি-ভাশুরের জানা ছিল বলেই তো ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন। লুকোচুরির এই খেলা আমাদের সাংস্কৃতিক ডিএনএ তে মিশে আছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২০২২ সালের তথ্যমতে ৫৪ শতাংশ ধর্ষণ মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ড. লিসা ফন্টেস বলছেন “পারিবারিক কলঙ্কের ভয়ে নিহিত সহিংসতা প্রজন্মান্তরে ছড়ায়।” শুধু রাষ্ট্র নয়, সমাজও এই অপরাধের দায় এড়াতে পারে না।
ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পরেও ভুক্তভোগী শিশুটির মা ও তার বড় মেয়েকে সামাজিক লজ্জা, অবজ্ঞা, অপমানের শিকার হতে হচ্ছে। শিশুটি এখনো হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। তার পরিবার এক অসীম শূন্যতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এ মুহূর্তে সমাজের বিবেকবান মানুষদের উচিত শিশুটির পাশে দাঁড়ানো। আর রাষ্ট্রের উচিত এ ঘটনা যেন আবার একটি সাধারণ মামলা না হয়ে যায় সেটি নিশ্চিত করা। ইতিহাস সাক্ষী সমাজ যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে তখনই ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে। মাগুরার শিশুটির জন্য কি ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে? নাকি আরও একবার নীরবতার আড়ালে অপরাধীদের মুক্তির পথ সুগম হবে? শিশু আছিয়ার অস্ফুট কান্না বাতাসে মিশে সারাদেশে আগুন জ্বেলে দিয়েছে। প্রতিটি হৃদয়ে ক্ষোভের লেলিহান শিখা। ফাঁসির দাবিতে উত্তাল সারাদেশ। পথে পথে রাজপথে মানুষ আর মানুষ। ধর্ষকের শাস্তি চাই। কিন্তু শাস্তির খড়গ যেন থাকে ন্যায়বিচারের মসৃণ হাতেই। আইনের কঠোরতায় যেন অন্ধকারে ঢেকে না যায় মানবতার মোমবাতি।

লেখক : শিক্ষক

×