
বাংলাদেশ একসময় জলসম্পদে ভরপুর একটি দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল
বাংলাদেশ একসময় জলসম্পদে ভরপুর একটি দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কৃষিতে অতিরিক্ত পানির ব্যবহার, শিল্পকারখানার প্রসার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এই সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করছে।
কৃষি, গৃহস্থালি ও শিল্প খাতে ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ভবিষ্যতে দেশ আরও ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়তে পারে। তাই এখনই সচেতন না হলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। এক সময় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা এত বেশি ছিল না। নদী, খাল, বিল ও পুকুরের পানিই দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু ক্রমাগত নগরায়ণ ও জলাশয়ের বিলুপ্তির ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়তে থাকে।
গ্রামাঞ্চলেও কৃষিকাজের জন্য অগভীর নলকূপ ও গভীর নলকূপের ব্যবহার বাড়ায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা অনেকগুণ বেড়েছে। ধানচাষের জন্য বাংলাদেশে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। এক সময় বৃষ্টিনির্ভর চাষাবাদ করা হতো, কিন্তু এখন সেচের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পরিবর্তে জমি চাষের জন্য অধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে একসময় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এতটাই নিচে নেমে যাবে যে তা পুনরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটসহ দেশের বড় শহরগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ঢাকা ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, শহরের ৭০ শতাংশ পানি ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে তোলা হয়। প্রতিদিন কয়েক হাজার কোটি লিটার পানি তোলা হচ্ছে, অথচ এর তুলনায় ভূগর্ভস্থ স্তরে পানি পুনরায় প্রবেশ করার হার অত্যন্ত কম।
ফলে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর এক থেকে দেড় মিটার পর্যন্ত নিচে নামছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ভয়ংকর পরিণতির ইঙ্গিত দেয়।
রাজশাহী অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট কৃষি উৎপাদনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এই অঞ্চলের কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় সেচের পানি প্রায় পুরোপুরি ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে আসে। অধিকাংশ নলকূপের পানির স্তর আগের তুলনায় অনেক নিচে নেমে গেছে। অনেক জায়গায় গভীর নলকূপ বসিয়েও পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্বল্পতার কারণে কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
শিল্পকারখানাগুলোও ভূগর্ভস্থ পানি সংকটের অন্যতম কারণ। অনেক কারখানা অনুমোদন ছাড়াই অতিরিক্ত পরিমাণে পানি উত্তোলন করছে। টেক্সটাইল ও চামড়া শিল্পে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো ভূগর্ভস্থ পানি থেকেই সংগ্রহ করা হয়। সরকারের কড়াকড়ি নজরদারি না থাকায় অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান পানি ব্যবহারে যথাযথ নিয়ম মেনে চলছে না। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামছে এবং আশপাশের এলাকায় পানির সংকট তৈরি হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনও ভূগর্ভস্থ পানির সংকটের অন্যতম কারণ। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, নদীর প্রবাহ কমে যাওয়া, উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে পানির স্বাভাবিক সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আগে বৃষ্টির পানি ভূমিতে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক রাখত। কিন্তু এখন অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে কংক্রিটের আবরণে ঢাকা শহরগুলোতে পানি মাটির নিচে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির পুনঃভরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ সংকট মোকাবিলায় এখনই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। প্রথমত, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। নদী, খাল ও জলাশয়ের পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। শহরাঞ্চলে ভবন নির্মাণের সময় রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এটি করলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে তা ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত, কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে বর্ষার পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য বিকল্প পদ্ধতি চালু করা গেলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমবে। শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর নজরদারি চালাতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়া অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
একই সঙ্গে শিল্প খাতে পুনঃব্যবহারযোগ্য পানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। টেক্সটাইল ও চামড়া শিল্পে ব্যবহৃত পানি পরিশোধন করে পুনরায় ব্যবহার করলে পানির অপচয় কমবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমবে।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ সংকট এড়ানো সম্ভব। জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে পানির সংরক্ষণ ও ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। গণমাধ্যমের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতা বৃদ্ধি ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমেই ভূগর্ভস্থ পানির সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেরি করলে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছাবে, যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন হবে। তাই সময় থাকতেই আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং পানি ব্যবহারে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। পানির অপচয় বন্ধ করতে হবে, ভূগর্ভস্থ পানির বিকল্প খুঁজতে হবে এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তবেই আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করতে পারব।