
নারীর মুক্তি সম্পূর্ণ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না পুরুষেরও মুক্তি হয়
নারীর মুক্তি সম্পূর্ণ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না পুরুষেরও মুক্তি হয়। অনেকে নড়েচড়ে বসবেন হয়তো, পুরুষের মুক্তি! সে আবার কি? কার কাছ থেকে? উত্তর, প্রচলিত সংস্কার থেকে। গতানুগতিক চিন্তা থেকে। যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা মিথ থেকে। পুরুষ প্রচলিত সংস্কারে আচ্ছন্ন থাকবে আর নারী বিকশিত মানুষ হবে, এ ভাবনা অবাস্তব। একজন সংস্কারমুক্ত যৌক্তিক মানুষই আরেকজন মানুষকে যৌক্তিকভাবে বিচার করতে পারে।
চিন্তার এ সামগ্রিকতা প্রয়োজন নারী-পুরুষ উভয়েরই। সংস্কার তৈরি হয় নারী-পুরুষের যৌথ জীবন ধারায়, উৎপাদন কাঠামোকে কেন্দ্র করে। এ থেকে বেরোতে দুজনারই সমান আন্তরিকতা প্রয়োজন। নইলে দুজনার বিকাশই ব্যাহত হয়। সংস্কার আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। একে দেখা যায় না, এর পীড়ন অনুভব করা যায়। এ থেকে বেরোনো সম্ভব নয় একা নারী কিংবা পুরুষের পক্ষে। একেবারেই নয়।
একশ’ বছরেরও আগে এ কথা বুঝেছিলেন বেগম রোকেয়া। বলেছিলেন, ‘আমরা সমাজেরই অর্ধ-অঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে, একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই।
শিশুর জন্য পিতামাতা উভয়েরই সমান দরকার।’ বুঝেছিলেন মেরি ওলস্টোন ক্রাফট। ফরাসি বিপ্লবের আবহে যিনি বেড়ে উঠেছিলেন। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী ধারণ করে লিখেছিলেন বিখ্যাত দুই বই। ‘দি ভিন্ডিকেশন অব দি রাইটস অব উইমেন’ এবং ‘দি রংগস অব উইমেন।’ তিনি বলেছিলেন, নারীর অধিকার স্বীকৃত হলেও তা বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বাস্তবায়ন করা কঠিন।
সেই আঠারো শতকে তিনি যা উপলব্ধি করেছিলেন আজ এত বছর পরও তা সমান প্রযোজ্য। আরও বলেছিলেন, ‘নারীর প্রতি প্রত্যক্ষ অপমান ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ, কিন্তু নানাবিধ বিশেষণে গাল ভরা প্রশংসা করে তাকে যে অন্তঃপুরে রুদ্ধ করে রাখা হয় তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা খুবই কঠিন।’
১৭৮৯ সালের সেই বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নতুন দিগন্তরেখা স্পষ্ট করে। বিপ্লবের প্রভাবে ফরাসি চিন্তাবিদদের মনে নতুন ভাবধারা জন্ম নেয়। এর প্রভাবে সমাজে আলোড়ন তোলার পাশাপাশি নারীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ওই বছরই ফরাসি নারীদের অগ্রগামী একটি দল ‘নারী ও পুরুষের সমান অধিকার’ পুনর্প্রতিষ্ঠা করার জন্য ‘শ্রম ও কাজের অধিকারের জন্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মে নিয়োগের জন্য’ শিরোনামে একটি স্মারকলিপি ফ্রান্সের জাতীয় পরিষদে পেশ করে। তাদের বক্তব্য ছিল, নারীদের যদি ফাঁসিকাষ্ঠে ওঠার অধিকার থাকে, তাহলে মঞ্চে ওঠার অধিকারও আছে।
সেই প্রথম স্পষ্ট করে কিছু বলা। অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টিও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মধ্যবিত্ত নারীরা শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সামনে আনেন। তারা বললেন, পরিবারে নারীর ভূমিকা ও মর্যাদা নির্দিষ্ট হতে হবে, সম্পত্তিতে অধিকার দিতে হবে এবং নারীর নিজের রোজগারের ওপর তার অধিকার আইনত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসব দাবি জানাতে গিয়ে এক সময় ভোটাধিকারের দাবি সামনে এসে পড়ে।
ভোটাধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন মূলত সম্পদশালী নারীরা। শ্রমিক নারীদের এতে সমর্থন ছিল। ধনী নারী আর শ্রমিক নারীদের স্বার্থ ছিল আলাদা। তাদের দাবি-দাওয়াগুলো সমান্তরালে আবর্তিত হয়নি কখনো। তাদের জীবনধারাই পরস্পরবিরোধী। আজও আমাদের এ ছোট দেশেও মধ্যবিত্ত নারীদের আন্দোলন পোশাক কারখানার শ্রমিক নারীদের আন্দোলন থেকে মৌলিক পার্থক্য বজায় রেখে চলছে।
কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধের জন্য যখন হাইকোর্ট রুল জারি করে পোশাক কারখানার হাজার হাজার নারী শ্রমিকের কাছে, তখন এই নিপীড়নের চেয়ে বেশি জরুরি হয়ে ওঠে মাস শেষে নির্দিষ্ট সময়ে মজুরি পাওয়া ও ন্যায্য মজুরির বিষয়টি।
সর্বজনীন ভোটাধিকার পেতে পুরুষদেরও সংগ্রাম করতে হয়েছে। ১৮৬৭ সালের আগে সম্পদশালী উচ্চ শিক্ষিত পুরুষরাই শুধু ভোট দিতে পারতেন। নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলন যখন চরম রূপ নিয়েছে, তখন সরকার ও বিত্তবানদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পুরুষের মতো ধনী উচ্চশিক্ষিত নারীদের ভোটাধিকারের বিষয়টিই কেবল বিবেচনা করা যেতে পারে। আসলে আঠারো শতক থেকে বিশ শতক পর্যন্ত সময় ছিল অধিকার অর্জনের আন্দোলনে ঘটনাবহুল সময়।
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে প্রগতিশীল নারী ফ্রন্টের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে জার্মান সমাজতন্ত্রী নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর দুবছর আগে ৮ মার্চ শিকাগো শহরের শ্রমিক নারীরা আট ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবিতে আন্দোলন করলে পুলিশের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। তাতে বেশ ক’জন নারী শ্রমিক নিহত হন।
সেই শ্রমিক নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে অনুমোদন দেয়। জাতিসংঘ অনুমোদন দেওয়ায় তার নিজেরও কিছু দায়বদ্ধতা এসে যায়। ঘোষিত হয় নারী দশক, রচিত হয় সিডও সনদ, অনুষ্ঠিত হয় নারী সম্মেলন। সবই আন্তর্জাতিক পরিম-লে। জাতীয় পর্যায়েও কাজ হয় কিছু কিছু।
আমরা এগোচ্ছি...। আন্দোলনে এগোচ্ছি। দলিল দস্তাবেজে এগোচ্ছি। শুধু একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়Ñ এ চলা জীবনের বাস্তবতাকে ছুঁতে পারছে তো? করপোরেট ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে অত্যাধুনিক চেয়ারে বসে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো তরুণ যখন বিয়ের পূর্বশর্ত হিসেবে কন্যার বাবার দেওয়া ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তরের দিন গোনে, প্রসঙ্গটি তখন বড় বেশি প্রশ্নবোধক হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ হৈমন্তী গল্পে লিখেছেন, ‘কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না।
তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিয়ের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিত উপরে আছে, সেই জন্যই তাড়া।’ শিক্ষায় যোগ্যতায় সমান পারদর্শী মেয়ের বিত্তবান বাবা বিয়েতে মেয়েকে সাজানোর জন্য এক সেট গয়না আর যে ঘরে সে যাবে, সে ঘর সাজাতে এক সেট ফার্নিচার দেন ‘উপহার’ হিসেবে।
এ ‘উপহার’ নিতে বেশিরভাগ শিক্ষিত মেয়েরও কোনো আপত্তি থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণি অর্জন করা মাস্টার্স পাস মেয়ের বিয়ে হয় ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে লেগেছে’ গোছের দায়সারা পদ্ধতিতে। তারপর সে মেয়ে স্বামীর হাতে খুন হয়ে ফিরে আসে। স্বামী গুরুপাপের লঘুদ- নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। এভাবেই চলছে।
কাকে দুষব ব্যক্তিকে, প্রতিষ্ঠানকে, নাকি পদ্ধতিকে। সিস্টেম তৈরি করে ব্যক্তিকে, আবার ব্যক্তি প্রভাবিত করে সিস্টেমকে। যারা ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদের কথা বলেছিলেন, তারা নারীর কাজকে গৃহের চৌহদ্দি থেকে বের করে সামাজিক শ্রমের মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্ত আজও খুব কম ক্ষেত্রে নারীর শ্রম সামাজিক শ্রম হিসেবে মূল্যায়িত হয়।
গৃহকর্মে নারী যে শ্রম দেন, তাও মূলত সামাজিক শ্রম। একটি সংসার সুষ্ঠু সুন্দরভাবে এগিয়ে নিতে স্বামী-স্ত্রী দুজনার মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। এ দেশীয় সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আজও তা অনুপস্থিত।
তাহলে কি চলাতেই ভুল ছিল? দুজন চলতি হাওয়ার পন্থি না হয়ে একাকী পথ চলার আনন্দ খুঁজে নেওয়া হয়েছিল? তাও তো নয়। পথের সাথি হয়েছিলেন অনেকে সেই শুরু থেকে। অনেক বিরোধ থাকার পরও। আজও আছেন চলার সঙ্গী। নইলে একটুও এগোনো সম্ভব হতো না। যেটুকু অর্জন তা যৌথ চলারই ফল। নারী এবং পুরুষ দুজনার যৌথ চলাই কেবল এগিয়ে নেবে সামনে একশ’ বছর দুশ’ বছর হাজার বছর। এর কোনো বিকল্প নেই।