
৮ মার্চ ছিল বিশ্ব নারী দিবস। ১৯০৮ সালে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, বেতন বৃদ্ধি, ভোটাধিকারের দাবি এবং নির্যাতন-নিষ্পেষণ বন্ধসহ নারীদের সব অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রায় ১৫ হাজার নারী নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছিলেন। অতঃপর ১৯১১ সাল থেকে শুরু হওয়া দিবসটির ২০২৫ সালে ১১৪তম পর্ব অতিবাহিত হলো। শতাব্দী পার হয়ে অর্জিত হয়েছে অনেক সাফল্য। প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহার বিশ্ববাসীকে পরস্পরের কাছাকাছি এনে দিয়েছে। ফলে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে, যার সিংহভাগ সুবিধাভোগী হচ্ছে নারী সমাজ। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ অনেকের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এক্ষেত্রে অন্যতম হলো ফ্রিল্যান্সিং। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ফ্রিল্যান্সিং পেশায় নারী ও পুরুষ উভয়ই তাদের দক্ষতা প্রমাণ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে নিবন্ধিত সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে ১১ শতাংশই নারী (অর্থাৎ ৭১ হাজার ৫০০ জন)। তবে দেশে মোট ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ এবং এই সংখ্যার মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণ ২৫ শতাংশের কাছাকাছি। তারা বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন। যেমনÑ গ্রাফিক ডিজাইন, কনটেন্ট রাইটিং ও ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স। পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা কম হলেও তাদের সফলতা এবং কাজের মান খুবই উন্নত। এছাড়া বিগত মাত্র কয়েক বছরে ১০ হাজার ৫০০ নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। দেশে ৮৬ শতাংশ পুরুষের কাছে মোবাইল ফোন রয়েছে যেখানে শুধু ৬১ শতাংশ নারী মোবাইল ফোনের মালিক। ৪০ শতাংশ পুরুষের তুলনায় ৩১ শতাংশ প্রযুক্তি-অক্ষম নারীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নারী উদ্যোক্তা, কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা তাদের কর্মপরিধি বাড়াচ্ছেন। সেই সঙ্গে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও অন্যান্য অনলাইন মার্কেটপ্লেসে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। কনটেন্ট রাইটিং, ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ে নারীরা অনেক ভালো করছেন। ২০২৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারী ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ ডিজিটাল মার্কেটিং এবং কনটেন্ট রাইটিংয়ের মতো সেক্টরে কাজ করছেন। নারীদের মধ্যে এ কাজগুলো জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলোÑ এ কাজগুলো ঘরে বসে করার সুবিধা এবং টাইম ফ্লেক্সিবিলিটি। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যবসা দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে। বহুসংখ্যক ভোক্তা অনলাইনে জিনিসপত্র ক্রয় করছেন এবং এর সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যাও বেড়েছে। ফেসবুকে ৩ লাখের বেশি বাংলাদেশী খুচরা বিক্রেতা রয়েছেন, যাদের ৫০ শতাংশ নারী।
আইটি সেক্টর বিপুলসংখ্যক বৈচিত্র্যময় এবং সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় নারীদের অর্থ উপার্জন করতে এবং পরিবারকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে আরও স্বাধীন হতে সুযোগ তৈরি করছে। জিএসএম অ্যাসোসিয়েশনের মতে, গোটা বিশ্বে পুরুষের তুলনায় ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন সুবিধা ভোগ করতে পারে গড়ে প্রায় ৮৫ শতাংশ নারী। বলা যায় ডিজিটাল প্রযুক্তি নারীদের জন্য বিভিন্ন কাজকে যেমন সহজ করেছে তেমনি তাদের সময়ও সাশ্রয় হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ই-কমার্স ও প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবসাগুলোর ধরনই এমন যে, এর সাহায্যে নারীরা পেশাগত কাজের পাশাপাশি সাংসারিক দায়িত্ব পালনে আরও নমনীয়তা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছেন। ইন্দোনেশিয়ায় ই-কমার্স থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের ৩৫ শতাংশই আসে নারী মালিকানায় পরিচালিত ব্যবসা থেকে। একইভাবে, চীনে নতুন গড়ে ওঠা ইন্টারনেট ব্যবসার ৫৫ শতাংশই নারীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আলিবাবা কোম্পানির টাওবাও ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে দোকান মালিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের সমান। এমনকি গোটা বিশ্বের ১৪৭ জন স্বনির্মিত নারী বিলিয়নিয়ারের মধ্যে ১১৪ জনই চীনের। অথচ এক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন মাত্র ১৪ জন নারী।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর ভিত্তিতে ১ জানুয়ারি ২০২৪ সালে প্রাক্কলিত বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার। যেখানে নারী ৮ কোটি ৭৩ লাখ ৯০ হাজার এবং পুরুষ ৮ কোটি ৪২ লাখ। অর্থাৎ দেশের পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ৩১ লাখ ৯০ হাজার বেশি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে (মার্চ ২০২৪,) বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তর, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা রয়েছেন ৪০ হাজার ১৮ জন নারী। ১০-১২তম গ্রেড বা দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা ৬৬ হাজার ৫৮ জন। ১৩-১৬ গ্রেড বা তৃতীয় শ্রেণির ২ লাখ ৪৭ হাজার ১৬২ সরকারি চাকরি করছেন। এ ছাড়া ১৭-২০ গ্রেড পর্যন্ত চতুর্থ শ্রেণিতে নারী কর্মচারী রয়েছেন ৫৫ হাজার ৮৭ জন। অর্থাৎ দেশে সরকারি চাকরিতে বর্তমানে ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৮ জন নারী-পুরুষ কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে নারী ৪ লাখ ৯১ হাজার ১৩৯ জন, যা মোট সরকারি চাকরির ২৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত কয়েক বছরে সরকারি চাকরিতে নারীর সংখ্যা বেড়েছে ২ শতাংশের বেশি। এমনকি প্রশাসনের শীর্ষ পদেও দিন দিন নারীদের উপস্থিতি বাড়ছে। ২০০৫-০৬ সালে চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৯০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার সায়েন্স অথবা তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত বিষয়সমূহ নিয়ে পড়ছেন প্রায় ২৫ শতাংশ মেয়ে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৫ শতাংশ ছাত্রীর মধ্যে পড়ালেখা শেষে ১৩ শতাংশ আইসিটি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে এই সংখ্যা অনেক বেশি।
স্পষ্টতই সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পরিবারগুলোতে নারীর গুরুত্ব বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০০৪, ২০১১ ও ২০২৩ সালের আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপের তথ্যানুয়ায়ী, গত প্রায় দুই দশকে নারীপ্রধান পরিবারের হার বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ ছাড়া কর্মজীবী নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করায় পরিবার পরিচালনায় তাদের সক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সংসারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো এখন নারীরাই নিচ্ছেন। এগুলো অনেকটাই সম্ভব ও সহজ হয়েছে প্রযুক্তির কল্যাণে। অর্থাৎ তারা সকলেই আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত এবং প্রযুক্তির কল্যাণে পুরুষদের সহায়তা ছাড়াই পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারছেন। দেশের গ্রামপর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছালেও এর নানা শিক্ষামূলক ও উৎপাদনমূলক ব্যবহার হচ্ছে না। গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন (জিএসএমএ) গত অক্টোবরে ‘দ্য স্টেট অব মোবাইল ইন্টারনেট কানেকটিভিটি ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের হার শহরে ৪৩ এবং গ্রামে ২৭ শতাংশ। যদিও ‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৪’-এ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারে পুরুষের তুলনায় নারীর আগ্রহের কথা উঠে এসেছে। বর্তমানে সমগ্র দেশেই স্বল্পমূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা সম্প্রসারিত হয়েছে। ইলন মাস্কের স্টারলিংক ইন্টারনেট স্থাপন হলে প্রান্তিক নারীরা ঘরে বসেই এর সদ্ব্যবহার করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবেন।
কিন্তু প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে নারী হয়রানি-নির্যাতনের ধরনও পাল্টেছে। কাউকে ফাঁসাতে বা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে গোপনে ছবি তুলে, সম্পর্কের অবনতিতে অন্তরঙ্গ ছবি ছড়িয়ে, কৌশলে মোবাইল ফোন থেকে ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে অথবা ছবি সম্পাদনা করে নারীকে হেয় করার পন্থা চলছে। মোবাইলে অশ্লীল বার্তা প্রেরণ, একজনের মুখের ছবিতে অন্যের আপত্তিকর ছবি জুড়ে দেয়া, ফেসবুক ও ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি-ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে দেওয়াসহ নানা ধরনের সাইবার অপরাধ হয়ে উঠছে নারী নির্যাতনের সহজ মাধ্যম। ভুয়া অ্যাকাউন্ট, পাইরেসি, অশ্লীল ছবি পোস্ট করা, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট করা, ইভটিজিং, পর্নোগ্রাফি এখন সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি এ প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। তাই নারীবান্ধব নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বাড়িয়ে নারীদের সময়োপযোগী দক্ষ করার পরিবেশ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়