
ইউক্রেনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বর্তমানে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত। কিছুদিন আগে ওভাল অফিসে ইউক্রেন যুদ্ধ কেন্দ্র করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভালোদিমির জেলেনস্কির মাঝে তীব্র বাকবিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। এই বিরল পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই ইউক্রেনের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। কেননা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রায় ৩ বছর থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান। শুরু থেকে এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা মিত্ররা সরাসরি অস্ত্র এবং আর্থিক সাহায্য দিয়ে আসছিল। বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে শেষ সময়ও ২৫০ কোটি মার্কিন ডলারের অস্ত্র সাহায্য দিয়ে গিয়েছিল। যার মধ্যে ছিল আকাশ প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম, ড্রোন মোকাবিলার অস্ত্র, উচ্চ সঞ্চরণশীল আর্টিলারি রকেট ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক সনঞ্জাম, ট্যাংক মোকাবিলার হাতিয়ার ও কামানের গোলাবারুদ। সেই সঙ্গে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার অনুমতি দিয়ে যান বাইডেন।
কিন্তু মার্কিন ক্ষমতার পালাবদলে ইউক্রেনের আকাশে মেঘ কালো হতে থাকে। ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পরই মস্কো ঘেঁষা নীতি অবলম্বন করতে থাকে। তার সর্বশেষ প্রতিফলন ঘটে যখন ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের প্রকাশ্যে বাকবিতণ্ডায় জড়ানো। ট্রাম্প এবং ভ্যান্সে অভিযোগ করেন জেলেনস্কি শান্তি চাচ্ছেন না এবং তার দেশ ইউক্রেন যুদ্ধে ভালো অবস্থায় নেই। তার উচিত ছিলো সমস্যা সমাধান কূটনৈতিক উপায়ে সমাধান করা। যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র সহায়তায় না দিলে তিন দিনও যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে না। ট্রাম্প প্রশাসন যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনকে ছাড়ের প্রস্তাব এবং চাপ দিতে থাকে। এই ছাড় যে সরাসরি পুতিনের পক্ষে যাবে এতটুকু নিশ্চিত বলা যায়। ‘ ইউক্রেনের নিরাপত্তার বিষয়টা এক প্রকার উপেক্ষা করা হলো। এমন সময়ে এ ধরনের প্রস্তাব আসলো যখন ইউক্রেনে তার মূল ভূখণ্ডের অনেকটা অংশ হারিয়েছে এবং খোয়া গিয়েছে হাজার হাজার সৈন্য এবং অস্ত্র। অথচ ইউক্রেন প্রথম দিকে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চাইছিল, কিন্তু সাবেক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিজ জনসন জেলেনেস্কিকে এই বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিয়েভ যদি মস্কোর সঙ্গে আলোচনা বাতিল করে লড়াই চালিয়ে যায়, তাহলে যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ সামরিক ও আর্থিক সহায়তায় পাবে। সময়ের সঙ্গে এখন অনেকটাই আলাদা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমেরিকা যে কোন লাভ ছাড়া কাউকে কোনো কিছু দেয় না তা স্পষ্ট হয়, যখন ইউক্রেনে বিরল খনিজ ও ধাতবের সন্ধান পাওয়া যায়, এতে চোখ পরে আমেরিকার। ট্রাম্প প্রশাসন খনিতে প্রবেশাধিকার জন্য চুক্তি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং এক প্রকারের চাপ দিতে থাকে। অস্ত্র সহায়তা এবং খনিজ সম্পদ বিষয়ে চুক্তি করতেই গিয়েছিলেন জেলেনস্কি। ট্রাম্প এক সময় বলে বসেন, খনিজ সম্পদের অর্ধেক আমেরিকার যতক্ষণ না ৫০০ মিলিয়ন ডলার ফেরত দেয়। জেলেনেস্কি সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যাখ্যান করলে ট্রাম্প ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। জেলেনস্কিকে বিষাক্ত ডিকটেটর বলে আক্রমণ করেন। একপর্যায়ে ট্রাম্প উঠে চলে যান এবং জেলেনস্কিকে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়।
আশার কথা হলো ইউরোপীয় দেশগুলোর ইউক্রেনের সঙ্গে থাকার সর্বাত্মক প্রতিশ্রুতি দেয়। যুক্তরাজ্য ২২৬ কোটি পাউন্ড সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। অনেক দেশ ট্রাম্পের চরম সমালোচনা করে ট্রাম্পকে মাফিয়া বলে আক্রমণ করে। ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে সব থেকে কড়া ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি প্রধান কাজা কালাস। তিনি ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, এটি পরিষ্কার, মুক্ত বিশ্বে নতুন একজন নেতা প্রয়োজন। আবার তড়িঘড়ি করে ইউরোপীয় নেতারা ইউক্রেনের জন্য জরুরি বৈঠকে বসে এবং চারটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য দেওয়া হবে এবং রাশিয়ার ওপর আর্থিক চাপ বহাল রাখা হবে। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা বজায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি আনতে হবে এবং শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। শান্তিচুক্তিতে ইউক্রেনের আত্মরক্ষার ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা থাকবে। ভবিষ্যৎ আগ্রাআগ্রাসন বন্ধ করতে এটা জরুরি। এই চুক্তি যাতে ঠিকভাবে কার্যকর হয় সেটা নিশ্চিত করতে ‘কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং’ গঠন করতে হবে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
যদিও বোঝা যাচ্ছে আমেরিকা পাশে না থাকলেও ইউরোপীয় মিত্ররা কিয়েভের পাশে থাকছে। প্রশ্ন উঠছে কতদিন অন্যের ওপর নির্ভর করে যুদ্ধের মতো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কত দিন সম্ভব। পুতিনের মতো ঝানু খেলোয়াড়কে সামলাতেই কিয়েভকে নাভিশ্বাস খেতে হচ্ছে, আবার এখন নতুন করে ট্রাম্পকে। এ যেন অহিনকুল অবস্থা। আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতি দেখে প্রেসিডেন্ট থিয়োডর রুজভেল্টের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একটি উক্তি মনে হলো, ‘মুখে রেখো নরম কথা, হাতে রাখো লাঠি’। এ কথারই যেন ফলশ্রুতি দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববাসী পৃথিবীতে কোনো যুদ্ধ চায় না। বন্ধ কোনো সব যুদ্ধ, পৃথিবীতে নেমে আসুক শান্তি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ