
চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির কারণে সাধারণ মানুষ বর্তমানে অতীতের মতো বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন না। দেশের বিভিন্ন স্থানে সহজে অসুস্থরা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। রোগে আক্রান্ত অবস্থায় চিকিৎসা করালে আমরা সুস্থ হচ্ছি একথা যেমন ঠিক, তেমনি রোগে আক্রান্ত না হওয়ার পূর্বে সচেতন নই বলে আমরা পড়ছি নানা ঝামেলায়। মৃত্যুহার কমছে, জন্মহার বাড়ছে। এ বিষয়ে আমরা চিন্তা করলে বুঝতে পারব-দেশের মানুষ অনেক সচেতন হয়েছেন। আজকাল সচরাচর যা দেখা যায় না তা হলো ‘বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি’। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি কি তা জানে না। এক শিক্ষার্থীকে বললাম, তোমাদের এখানে স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি চালু আছে? সে জবাব দিল এখানে কেন স্বাস্থ্যসেবা দিবে, আমরা লেখাপড়া করি এখানে, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যাবে মেডিক্যালে। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
আজ থেকে ৪০-৫০ বছর অতীতের কথা ভাবলে কেন জানি বিস্তর ফারাক দেখতে পাই। বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি তখন চালু ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। মাধ্যমিক পর্যায়েও যৎসামান্য দেখা যেত। বাংলাদেশে ১৯৫১ সালে বিদ্যালয় স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক কার্যক্রম শুরু হয়ে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ২৩টি বৃহত্তর জেলায় বিদ্যালয় স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐসব ক্লিনিকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জেলা শহরের বিদ্যালয়ে সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলেও অধিকাংশ কোমলমতি ছাত্রছাত্রী এ সুযোগ পেত না। এ স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সক্রিয় করতে এবং সাধারণরা যাতে অধিকহারে সচেতন হয় এ লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৯৬ সালে বিদ্যালয় স্বাস্থ্য পাইলট প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্প গড়ে তোলা হয়। এ প্রজেক্টে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও সম্পৃক্ত করা হয়। পরীক্ষামূলকভাবে এ কার্যক্রম শুরু করা হয় ৪টি জেলায়, যথাক্রমে কুমিল্লা, বগুড়া, ফরিদপুর ও যশোর জেলার অধীন ৩৯ উপজেলায়।
শিক্ষক ও সেবাদান কর্মী মিলে মোট ২০০০ কর্মী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ছাত্রছাত্রীদের কৃমির বড়ি খাইয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর একটি নিরপেক্ষ জরিপের মাধ্যমে জানা যায়, প্রকল্প এলাকায় অনেকে স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে। কৃমিতে আক্রান্তের পরিমাণ ৪০ ভাগ থেকে কমে শতকরা হিসেবে ২৩ ভাগে নেমে এসেছে। উল্লিখিত তথ্যগুলো পরিবেশন করলাম দুটি কারণে। ১. আমাদের সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করে ঠিকই, সেই উদ্যোগের সফলতা-বিফলতা বিষয়ে দেখার তেমন গরজ মনে করে না। ২. যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের অধিকাংশকেই নিজেদের আখের গোছানোর বিষয়ে অধিক যত্নবান হতে দেখা যায়। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার বালাই নেই বলে সকল কার্যক্রমে আমরা পিছিয়ে পড়ছি।
পুষ্টিহীনতা, ভিটামিন ‘এ’ অভাবজনিত অন্ধত্ব, আয়োডিনের ঘাটতিজনিত রোগসমূহ দূর করতে বিদ্যালয়ের ঝিমিয়ে পড়া স্বাস্থ্য ক্লিনিক সেবাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য উদ্বুদ্ধকরণ, শিশুদের বাড়তি খাবার দেওয়ার নিয়মসমূহ জ্ঞাত করানো, ভিটামিনযুক্ত খাবার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষক ও ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করে দেশের পুষ্টিহীনতা দূর করা যেতে পারে। একজন আদর্শবান শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দান করে এবং স্নেহের পরশে রেখে আগামীদিনের সুনাগরিক তৈরি করেন। ছাত্র-ছাত্রীরাও তাদের অর্জিত জ্ঞান দ্বারা অভ্যাসের পরিবর্তন ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আগামী দিনের সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এখনো অনেক বিদ্যালয় রয়েছে যেগুলোতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বালাই বলতে কিছুই নেই। স্বাস্থ্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে বিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, সৌচাগার পরিষ্কার রাখা, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা এবং খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
সুস্থ বিনোদনের অভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ে পিছিয়ে না থাকে সেদিকে শিক্ষকদের খেয়াল রাখতে হবে। তবে আনন্দের বিষয় হলো, বর্তমানে প্রায় বিদ্যালয়ে খেলাধুলা থেকে সংস্কৃতিবিষয়ক সবকিছু চর্চা বেড়েছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি সংগীত, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নাচ, গান সবকিছু বিদ্যালয়ে হচ্ছে। তবে চট্টগ্রামে কোনো কোনো বিদ্যালয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়া বা পরিবেশন করতে দেখছি না। কেন গাওয়া হয় না সেই বিষয়ে জানি না। অনুমানস্বরূপ বলছি, চট্টগ্রাম মহানগরীতে একাধিক ভাড়া বাসায় স্কুল দেখা যায়। হয়তোবা জায়গা সংকুলানের কারণে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হচ্ছে না। ফলে সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাতীয় সংগীতের ব্যাপারে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন আছে। যতটুকু জানি, স্কুল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন নিতে হলে খেলার মাঠসহ অনেক শর্ত রয়েছে। তারপরও কিভাবে ভাড়া বাসায় স্কুলে অনুমোদন পাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা তা অজ্ঞাত। দুই-একটা ভাড়া বাসায় জাতীয় সংগীত গাইতে দেখেছি। বিজ্ঞ মহলের দাবি, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিভিন্ন স্কুলের অনুমোদন দেওয়া হোক এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হোক। উল্লেখ্য, গ্রামের স্কুলগুলোতে যথারীতি জাতীয় সংগীত পরিবেশন বা গাওয়া হয়।
আমরা লেখাপড়া করেছি গ্রামের স্কুলে। তখন বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে আসতেন থানা বা উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে ইন্সপেক্টর। ইন্সপেক্টর আসার আগের দিন প্রধান শিক্ষক নোটিস পাঠাতেন খাতায় লিখিতভাবে দপ্তরির মাধ্যমে। শ্রেণি শিক্ষক নোটিস পড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের। নোটিসে লেখা থাকতো, আগামীকাল স্কুলে ইন্সপেক্টর আসবেন, তোমরা সকলে পরিষ্কার কাপড় পরে, মাথায় তেল দিয়ে চুল আছড়িয়ে সুন্দরভাবে আসবে। ক্লাসের পড়াও শিখে আসবে। ইন্সপেক্টর যা প্রশ্ন করবেন তার সঠিক উত্তর দিবে। আরও যেসব কর্মসূচি ছিল তা হলোÑ টিকাদান ও কৃমির ওষুধ খাওয়ানোর কর্মসূচি। এসব কর্মসূচিও স্কুলের প্রধান শিক্ষক উল্লিখিত নোটিস আকারে শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দিতেন। এখন ঐ ধরনের কোনো কর্মসূচির বালাই নেই। প্রাথমিক চেক-আপ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে হলে চিকিৎসকের বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারদের ভূমিকা অপরিহার্য বিষয়। চিকিৎসক টিম গঠন করে কর্মসূচি নির্ধারণ করে বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া একটা ইতিবাচক দিক।
সরকারের আরেক সিদ্ধান্ত ‘জরায়ু টিকা’। জরায়ু রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক মহিলা মারা যাচ্ছেন, যা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। মারাত্মক এ সমস্যা সমাধানে এখন চলমান রয়েছে ‘জরায়ু টিকা’ প্রদান কর্মসূচি। ১১ বছর বয়সের মেয়েদের এই টিকা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগ এবং পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের যৌথ প্রচেষ্টায় এ কার্যক্রম চলছে। সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালসহ সকল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে জরায়ু টিকা দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বাস্থ্য শিক্ষা নিয়ে তাদের স্বাস্থ্যকর আচরণে অভ্যস্ত করা গেলে সমাজ যেমন উপকৃত হবে, তেমনি দেশও ক্রমান্বয়ে রোগমুক্ত হবে। শিক্ষার্থীরা বাড়িতে শিশুদের পিতামাতাকে স্বাস্থ্যজ্ঞান দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে। বর্তমান সরকার স্বাস্থ্যসেবা সাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। স্বাস্থ্য সহকারী এবং পরিবার পরিকল্পনা সহকারীর মাধ্যমে চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছেন সকল শ্রেণির মানুষ। এই কর্মসূচির সফলতা আসবে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে। স্বাস্থ্য সম্পর্কে সজাগ থাকলে পরিবারে অমানিশার ছায়া পড়বে না। বিদ্যালয় স্বাস্থ্য কর্মসূচির বিষয়ে অভিজ্ঞমহল সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহযোগিতা কামনা করেন।
লেখক : সাংবাদিক