ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১০ মার্চ ২০২৫, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১

দুগ্ধ উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ

খামারিদের সুরক্ষায় করণীয়

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২০:২০, ৯ মার্চ ২০২৫

খামারিদের সুরক্ষায় করণীয়

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। যার সঙ্গে দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রীর চাহিদাসহ উৎপাদনও বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকারের  প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (২০২১)  এর তথ্য মতে দেশে প্রতি বছর ৯০ লাখ ২৪ হাজার টন দুধ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু চাহিদা রয়েছে ১ কোটি ৫৮ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টনের কিছু বেশি। এর মানে হলো বাংলাদেশ তার মোট প্রয়োজনের মাত্র ৬৩ শতাংশ উৎপাদন করছে এবং বাকি ৩৭ শতাংশ ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতি বছর প্রায় এক হাজার পাঁচশ কোটি টাকার দুধ আমদানি করছে। সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা গুঁড়ো দুধ আমদানিতে ব্যয়িত হয়, তা যদি স্থানীয় দুগ্ধ উন্নয়নে ঋণ কিংবা প্রণোদনা হিসেবে ব্যবহৃত হতো তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হতো। কিন্তু দেশে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির পথে প্রধান অন্তরায়গুলো হলো- জমির দুষ্প্রাপ্যতা, গবাদি পশুর পর্যাপ্ত খাবারের স্বল্পতা ও গরুর উৎপাদন ক্ষমতা। সার্বিক ব্যবস্থাপনা তথা নীতি সহায়তা পেলে বাংলাদেশ যে দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে- এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি জনের প্রতিদিন ২৫০ মিলিমিটার দুধ পান করা প্রয়োজন। সেখানে একজন মানুষের প্রাপ্তি মাত্রা ৪০ মিলিমিটার। সেই হিসাবে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে সারাদেশে প্রতিদিন মাথাপিছু দুধের চাহিদা ১৪.৪৮ মিলিয়ন টন এবং উৎপাদন হয় ৬.৯৭ মিলিয়ন টন। অর্থাৎ প্রতিদিনের ঘাটতি দাঁড়ায় ৭.৫১ মিলিয়ন টন। এ বিশাল ঘাটতি পূরণের জন্য এখন আমদানি বাণিজ্যই একমাত্র ভরসা। অথচ এসব পণ্যে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে তা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। অথচ এ শিল্পের বিকাশে বাংলাদেশে যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে তা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশ পুষ্টিতে স্বয়ম্ভর হবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপিতে তা ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ। যদিও পশু পালন উপখাতে জিডিপির ভাগ কম, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষের প্রয়োজন মেটাতে এর বিশাল অবদান রয়েছে। কয়েক বছর ধরে প্রাণিজ আমিষ যেমন- দুধ, মাংস (গরু, খাসি, মুরগি) এবং ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এসব পণ্যের বার্ষিক গড় দরদাম তেমন বাড়ছে না।

এসডিজি ও দুগ্ধ খাত

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি উপাত্তে দেখা যায়, দেশের মোট ২ কোটি ৮৭ লাখ গৃহস্থালির কৃষির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংযুক্ত রয়েছে। এ কৃষির উৎখাত প্রাণিসম্পদ দেশের প্রবৃদ্ধিতে, পুষ্টি উন্নয়নও খাদ্য নিরাপত্তায় অধিক ভূমিকা রাখছে, বিশেষত শ্রমঘন, স্বল্প পুঁজি ও স্বল্প জমির প্রয়োজন হেতু। বিবিএসের বৈদেশিক বাণিজ্য পরিসংখ্যান হতে দেখা যায় যে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে যথাক্রমে চামড়াজাত পণ্য (২০২৪.১০ কোটি টাকা), মাংস ও মাংসজাত (৯.৮৮ কোটি টাকা), দুগ্ধজাত পণ্য (১৫.৯৭ কোটি টাকা), প্রাণিজ উপজাত (১২৬.৮১ কোটি টাকা) অর্থাৎ সর্বমোট ২১৭৬.৭৭ কোটি টাকা। আবার উৎপাদন ১২.৮৩ লাখ টন, মাংস ৭১.৫৪ লাখ টন এবং ডিম ১৪৯৩ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। তারপরও দেখা যায় যে, দেশের বাড়তি জনসংখ্যার কারণে এসব উৎপাদন দেশের চাহিদা পূরণে সক্ষম হচ্ছে না। এখনো দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ ভুগছে পুষ্টিহীনতায় যাদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যাই বেশি। এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, সবার জন্যই পুষ্টি নিশ্চিত করতে হলে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা তৈরি, সুষম পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদের গুরুত্বের কথা উঠে এসেছে। এ বিষয়গুলো জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) প্রায় ৯টি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিধায় এ খাতকে গুরুত্ব দিলে এসডিজির দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সুস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে, বিশেষত ২০৩০ সালের মধ্যে। সরকারের ভিশন-২০২১ অর্জনে জনপ্রতি দিনে দুধ ১৫০ মিলিমিটার, চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কাজ করছে দেশের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। দেশকে উন্নত করতে হলে প্রথম প্রয়োজন মেধা, যার সঙ্গে প্রাণিজ আমিষের সম্পর্ক রয়েছে। এ বিবেচনায় সরকার প্রথমে সহস্রাদ্ধ উন্নয়ন লক্ষ (এমডিজি) এবং পরবর্তীতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে (এসডিজি) প্রাণিসম্পদ সেক্টরে ৯টি অভিষ্ট ও ২৮টি লক্ষ্যমাত্রা যুক্ত করেছে। এরই মধ্যে এ সকল অভিষ্ট ও লক্ষ্য অর্জনে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যেগুলোর বাস্তবায়নে প্রয়োজন আইন ও নীতিমালা সহায়তা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, ঋণ সহায়তা বৃদ্ধি, গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সেবার সম্প্রসারণ, প্রাণিসম্পদ বিমা ব্যবস্থার চালুকরণ ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি। আবার প্রাণিসম্পদ খাতে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গৃহীত নীতি ও কৌশলসমূহের মধ্যে রয়েছে প্রাণিসম্পদ সেবা সম্প্রসারণ, দুগ্ধ ও মাংস উৎপাদন, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে জাত উন্নয়ন, পশু-পাখির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকার, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইত্যাদি। এখন ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাণিসম্পদ সেক্টরে এসডিজি অর্জনের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে- (১) জনবলসহ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি (২) পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজার ব্যবস্থার উন্নতিকরণ (৩) পরিবেশ বাজার গবাদিপশু উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা (৪) তথ্যপ্রযুক্তির ঘাটতি (৫) খামার পর্যায়ের প্রণোদনার অপ্রতুলতা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনও  বিতরণ। ভোক্তা পর্যায়ে অপ্রতুলতা ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বিতরণ ও ভোক্তা পর্যায়ে সচেতনতার অভাব। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজস্ব বাজেট এবং ২৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়নের অগ্রগতি সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলছে। আশা করা যায়, ২০৩০ সালের আগেই প্রাণিসম্পদ বিশেষত দুগ্ধ উৎপাদন সম্পর্কিত এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত সম্ভব হবে। নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ উৎপাদন, বিপণন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণসহ গ্রামীণ জনগণকে সার্বিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে।
দুগ্ধ উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত বাংলাদেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়। অথচ দেশটি এর ভুক্তভোগী। এই চ্যালেঞ্জসহ কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কাজ করছে। চলতি মৌসুমের তাপমাত্রা এরই মধ্যে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে তাপমাত্রার উত্তাপ ছড়িয়েছে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। সড়ক-মহাসড়কের কোথাও কোথাও পিচ গলে গেছে। জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা মানুষের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। একই সঙ্গে প্রাণিকুলেরও। এ সময় দেশের প্রাণিসম্পদ বিশেষ করে দুগ্ধখামারিরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাপপ্রবাহের কারণে সবুজ ঘাস মরে গেছে। সংকট দেখা দিয়েছে ঘাসের। গরুর খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তাপপ্রবাহ থেকে গরুকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখতে খামারিদের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। একদিকে বেড়েছে ব্যয়, অন্যদিকে কমেছে দুগ্ধ উৎপাদন। ফলে খামারিরা আর্থিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সিরাজগঞ্জ ও পাবনা থেকে দেশে উৎপাদিত দুধের বড় অংশ আসে। বিস্তীর্ণ চারণভূমি ও উচ্চ উৎপাদনশীল বিভিন্ন জাতের গরুর আধিক্য থাকায় এ দুধ উৎপাদনে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। দেশে চলমান তাপপ্রবাহের কারণে এ দুই অঞ্চলেই কমেছে দুধ উৎপাদন। গরমে কাঁচা ঘাস না থাকায় এবং গবাদিপশু স্বাভাবিক খাবার খেতে না পারায় দুধ উৎপাদন কমেছে। তীব্র গরমে গরু মারাও যাচ্ছে। নদীর পাশে যেসব খামার রয়েছে, তারা সহজেই পানি পাচ্ছে। যারা বাড়িতে খামার করেছে, সেসব খামারে গরুর উপযোগী তাপমাত্রা বজায় রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মিল্ক ভিটা সূত্র বলছে, মিল্ক ভিটার লক্ষ্য প্রতিদিন গড়ে ৯০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করা। তবে প্রচণ্ড গরমের কারণে খামারিরা ৫০-৫২ হাজার লিটারের বেশি দুধ সরবরাহ করতে পারছেন না। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন খামারিরা। প্রাণিসম্পদ খাতে খামারিরা তাপপ্রবাহের মতো চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। তাদের সহায়তা ও সুরক্ষায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় খামারিদের সুরক্ষায় কাজ করতে হবে। পুষ্টিমানের বিচারে দুগ্ধপণ্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন সরকার তাদের অষ্টম বার্ষিক পরিকল্পনায় প্রাণিসম্পদের সংখ্যা উল্লেখ করেছে যথাক্রমে- দুগ্ধবতী গাভী ২৩.৬৪ মিলিয়ন, মহিষ ১.৪৬ মিলিয়ন এবং ছাগল ২৫.৬০ মিলিয়ন। এই সকল প্রাণী থেকে বৎসরে দুগ্ধ উৎপাদন হয় ৬.৯৭ মিলিয়ন টন, যা চাহিদার তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ কম। এর প্রধান কারণ বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তার অভাব। তাই পরিকল্পনা মেয়াদে বেশকিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। যেমন- ডেইরি খাতে সমবায়ের উপস্থিতি, ডেইরি চাষিদের উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ, গবাদিপশুর খাদ্য উৎপাদন, প্রাণী স্বাস্থ্য রক্ষায় ভেটেরিনারি সেবা বৃদ্ধিকরণ ও ক্ষুদ্রকায় খামারিদের ঋণ সুবিধা প্রদানসহ বিপণন ব্যবস্থা জোরদারকরণ। এ বিষয়গুলো সুষ্ঠু বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা ও বাজেট বরাদ্দ। দুগ্ধ থেকে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর বিশাল বাজার সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে, যার চাহিদা অফুরন্ত যদি তা ভেজালমুক্ত হয়। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে এই ভেজালবিরোধী আন্দোলনে শরিক হই এবং একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতি বিনির্মাণে এগিয়ে আসি। আমাদের স্লেøাগান হোক- ভেজালহীন পুষ্টিসমৃদ্ধ বাংলাদেশ আর দুগ্ধশিল্প হোক তার প্রথম সারির। এ বিষয়ে সরকারি প্রণোদনা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পাড়ে। আবহাওয়াবিদরা এরই মধ্যে পূর্বাভাস দিয়ে বলেছেন, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে দেশে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হতে পারে। ফলে চলমান তাপপ্রবাহের বিপর্যয়ের মধ্যেই খাতগুলো আরেকটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর সুরক্ষায় আগাম পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশী শিল্প খাত টিকিয়ে রাখতে সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা কাম্য।

দুগ্ধ খামারিদের সুরক্ষায় করণীয়

বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের লক্ষ্য ভোক্তার কাছে মানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য মানের দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। দুধকে একটি আদর্শ খাদ্য বলা হয়, যেখানে পুষ্টির সকল গুণাবলী রয়েছে, যা বিশেষ করে শিশুদের শারীরিক গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই দুধের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা সকলেরই দায়িত্ব। বিশেষ করে উৎপাদক (চাষি), ব্যবসায়ী (ঘোষ) ও প্রক্রিয়াজাতকরণ (কোম্পানি) পর্যায়ে, যার সঙ্গে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা/ খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত রয়েছে। তাই পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও শিশুর দুধে ভেজালজনিত বিষয়গুলোর একটি শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। বিশেষত, ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছানোর আগে অর্থাৎ আমরা একটি দারিদ্র্যমুক্ত, পুষ্টিহীন মুক্ত, ভেজালমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত সুশাসিত বাংলাদেশ দেখতে চাই। আমাদের সমস্যা আছে অনেক যা একদিনে সৃষ্টি হয়নি।  এসবের সমাধান দ্রুত সম্ভব নয়। এ কাজটি শুরু হয়েছে মন্থর গতিতে। যেমন- বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে বাজারে বিক্রি হচ্ছে এমন সব খাদ্যসামগ্রীর মান নির্ণয়ে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। কেবল আশ্বাস ছাড়া। সারা পৃিথবী ব্যাপী বিশেষত উন্নত দেশে দুধের মান পরীক্ষার অনেকগুলো প্যারামিটার থাকে। যেমন সিঙ্গাপুরে এ সংখ্যাটি ৩৮টি আর বংলাদেশে দুধের মান নির্ণয়ের প্যারামিটার মাত্র ৮টি। যার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক পরীক্ষা করার সামর্থ্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ও টেস্টিং ইননস্টিটিউটের (বিএসটিআই) নেই। এর সক্ষমতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। এর মধ্যে দুগ্ধ শিল্পের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে এবং জনস্বাস্থ্যেরও যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হলো- পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে দুধের অবদান অনস্বীকার্ষ এবং পুষ্টি বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় এটি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ দুগ্ধ শিল্পের ওপর শিক্ষা ও গবেষণা সুযোগ খুবই সীমিত। যদিও দেশে একটি ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়সহ দুতিনটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় কিংবা পশু পালন অনুষদে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রমে কিছু গবেষণা পরিচালিত হয়ে থাকে। এসব গবেষণার ফল দেশের দুগ্ধ শিল্পের বিকাশে কতটুকু অবদান রাখছেম তার সম্প্রসারণ ও প্রচারের দায়িত্ব সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ওপর ন্যাস্ত। এই সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েকটি ডেইরি ফার্ম সরকারি কাঠামোতে পরিচালনা করছে। যার মধ্যে সাভার ডেইরি ফার্ম উল্লেখযোগ্য। যার উদ্দেশ্য প্রজনন, উৎপাদন, গবেষণা ও সম্প্রসারণ। এ খামারের উৎপাদিত দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে শহরে বিপণন করা হয়, যা সাভার ডেইরি হিসেবে পরিচিত। মিল্কভিটাও দুগ্ধ প্রক্রিয়াজতকরণের ও দুগ্ধসামগ্রী বিতরণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। দেশে সরকারের পাশাপাশি ১৪টি বেসরকারি কোম্পানি দুগ্ধ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। যাদের পণ্যসামগ্রী মূলত তরল দুধ, মিল্ক পাউডার, ঘি, ছানা, পনির, মাখন ইত্যাদি। দেশীয় কোম্পানিগুলো মনে করে বর্তমানে প্রচলিত দেশীয় শিল্পনীতিকে সহায়তা দিলে গ্রামে অবস্থিত দুগ্ধ খামারি ও শহর কেন্দ্রিক কোম্পানিগুলো তরল কিংবা গুঁড়ো দুধের চাহিদা মেটাতে পারবে। আবার দুধ আমদানিতে বছরে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে, তা যদি দেশীয় শিল্পে বিনিয়োগ করা যেত তা হলে এই শিল্পে ঘুরে দাঁড়াতে পারত বাংলাদেশ। দেশের জনসাধারণ তাদের খাদ্য ও পুষ্টির জন্য কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব¡। জনগণের সাংবিধানিক অধিকার পূরণে সরকারের দায়িত্ব। এ খাতের উন্নয়নে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। গ্রাম অঞ্চলে খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান করতে হবে। এ অবস্থায় কর্মসংস্থান তথা পুষ্টির কথা বিবেচনায় রেখে এই শিল্পকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। আমরা একটি স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সমৃদ্ধজাত হিসেবে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করতে চাই। তুলনামূলক বিচারে প্রোটিন গ্রহণে আমরা যে অনেকের ছেয়ে পিছিয়ে আছি (মাত্র ৬৬ গ্রাম মাথাপিছু) তা বাড়াতে হবে। আমাদেরও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে প্রাণিজ প্রোটিনের বিশেষত দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে। তার জন্য সরকারের নীতি সহায়তা প্রণোদনা প্রয়োজন। যার মধ্যে রয়েছে পশু খাদ্যে ভর্তুকি, কম মূল্যে পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নেপিয়ার ঘাস উৎপাদন, পর্যায়ক্রমে প্রাণিজ খাদ্য আমদানি হ্রাসকরণ ইত্যাদি মনে রাখতে হবে, কৃষিবান্ধব সরকারের কিছু ভুলনীতির কারণে যেন দেশে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিমোচন ব্যাহত না হয়।

লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

×