ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১০ মার্চ ২০২৫, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১

দেশের উন্নয়নে নারীর ভূমিকা

মোসা. ফাতেমা-তুজ-যাহরা জেবা

প্রকাশিত: ২০:১৮, ৯ মার্চ ২০২৫

দেশের উন্নয়নে নারীর ভূমিকা

‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার এই উদ্ধৃতিটি আমাদের সমাজব্যবস্থায় কতটুকু প্রাপ্তি স্বীকার করে কিংবা করেছে তা অতীত ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিলে সহজেই উপলব্ধি হয়। কারণ কুসংস্কারের জাঁতাকলে আবদ্ধ ছিল তখনকার সমাজ। কিন্তু তখনকার সমাজ আর এখনকার সমাজব্যবস্থার মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। তাইতো লেখক নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলেছেন। এখন নারীরা আর পিছিয়ে নেই। পুরুষের পাশাপাশি অংশ নিচ্ছেন সকল কর্মকাণ্ডে এবং তারা সফলতার সহিত কার্যসিদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছেন। তবুও যেন নারীরা অনেক জায়গায় বাধা বিঘ্নের শিকার হচ্ছেন। দৈনন্দিন পত্র-পত্রিকা কিংবা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমরা নারীদের নির্যাতন, ধর্ষণ, বিভিন্ন ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত এমন ঘটনার দৃষ্টিগোচর হচ্ছি। মোটকথা মৌলিক অধিকার থেকে তাদের দূরে ঠেলে দিয়ে নারীদের শুধু তাদের লিঙ্গ ভিন্ন হওয়ার জন্য আমরা অবহেলা করি এবং পরিশেষে আমাদের মনে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করি যা নিতান্তই অনুচিত। কারণ অর্ধেক নারী জনসংখ্যার এই দেশে তাদের ছাড়া অবকাঠামোগত এবং পরিপূর্ণ উন্নয়ন সম্ভব নয়।
দেশের উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা অপরিহার্য। তারা শুধু সমাজের অর্ধেক নয়, উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। নারীরা তাদের বহুমুখী দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখেন। তাইতো নারীরা সমাজ এবং দেশের জন্য অভিশাপ নন বরং আশীর্বাদস্বরূপ। নারীরা কৃষি, শিল্প, সেবা খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বাংলাদেশের নারীদের বৃহৎ অংশ কাজ করেন পোশাক শিল্পে। আর এসব কাজে তাদের নানা প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। তারাও আগামী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুতকরণে সহায়তা করেন। তারা এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব পরিসরেও প্রশংসা কুড়াচ্ছেন।
অন্যদিকে নারী উদ্যোক্তা হয়ে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন এবং রাজস্ব আয় বাড়াতে সাহায্য করেন। এজন্য নারী শিক্ষা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিক্ষিত নারীরা তাদের পরিবার ও সমাজকে শিক্ষিত করতে সাহায্য করেন। সন্তানদের প্রথম শিক্ষার হাতেখড়ি কিন্তু তাদের মায়েদের কাছেই হয়। নারীরা পরিবারের স্বাস্থ্যের দায়িত্বও নেন এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে অন্যদের উৎসাহিত করেন। বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ এবং সমাজের দুর্বল শ্রেণির মানুষদের সহায়তা করেন। ভোটদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে সরকার গঠনে প্রভাব বিস্তার করেন। তাছাড়াও রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে দেশের উন্নয়ন এবং সমাজের রীতি-নীতি ও চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে পারেন। নারীরা সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশ করে দেশের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ করেন।  দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে অগ্রসর হচ্ছেন। কারণ নারীরা তাদের মেধা, মনন ও বাস্তবিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পুরুষের মুখাপেক্ষী হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছেন। অতীতে নারীদের নিয়ে যা ভ্রান্ত ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল তার দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন দেশের নরীরা। আর এই কঠিন বাধা ভেঙে নারীদের এগিয়ে আসা শিখেয়েছেন উপমহাদেশের প্রথম স্বশিক্ষিত ও মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। অন্তর্নিহিত মেধা সত্তাকে এবং প্রস্ফুটিত অধিকারকে কখনো নারীরূপে আবার কখনো বা তা পুরুষের ব্যঙ্গাত্মক অবয়বে ফুটিয়ে তুলেছেন মহীয়সী এই লেখিকা। নারীদের প্রতি পুরুষদের জ্ঞানবোধ জাগিয়ে তোলাই ছিল যেন লেখিকার মূল কাজ। নারীদের সকল ঘটনাবলীকে বাস্তবতার নিরিখে উপস্থাপন করতেই বঙ্গনারীদের মাঝে কলম সৈনিক হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নারীর আধিপত্যকে এবং নারীদের ভবিষ্যৎ স্বপ্নকে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য যথোপযুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তিনি। তিনি সুন্দর সমাজ ও সংসারের স্বপ্ন দেখেছেন যা তার লেখনীর মূল ধারা। এই মূল বিষয়বস্তুটি তিনি তুলে ধরলেও বাস্তবে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। তিনি বলেছেন, নরনারী একই সমাজের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ, পুরুষ শরীর-রমণী হল মন। একমাত্র শিক্ষার দ্বারাই রমণীদের দাবি অগ্নিস্ফুলিঙ্গে রূপ নিবে এবং ফলস্বরূপ নারী উন্নয়ন পর্যবসিত হবে। তাইতো বেগম রোকেয়া অন্তঃপুরবাসিনী থেকে বের হয়ে এসে শিক্ষা অর্জনের ডাক দিয়েছেন এবং নারীশিক্ষাকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখতে শেখা ও প্রত্যাশিত স্বপ্নকে পূরণের অভিপ্রায়ে বাস্তবে ফুটিয়ে তুলতে নিজেকে কত রকমের বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় এবং কিভাবে এগুলো থেকে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে আবার শক্ত অবস্থানে দাঁড় করানো যায় সেটাই শিখিয়েছেন রোকেয়াসহ বিভিন্ন লেখিকা এবং মহর্ষিগণ।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীরা দেশের উন্নয়নে তাদের সর্বোচ্চ বিসর্জন দিয়ে কাজ করে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছেন এবং ইতিবাচক প্রভাব রাখছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নারীর অগ্রগতি সর্বদা দৃশ্যমান। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের নারীরাও আর বাড়িতে বসে নেই। তারা স্বগুণে ও যোগ্যতায় দেশের নানাক্ষেত্রে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন এবং সেসব স্থানে উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। বর্তমানে পটভূমির কিছুটা পরিবর্তন হলেও দেশের অভ্যন্তরে এখনো অনেক অসঙ্গতি রয়ে গেছে। পরিবর্তন এখনো হয়ে ওঠেনি মানুষের চিন্তাভাবনা ও নীতি-নৈতিকতায়। তাই দেশের সার্বিক উন্নয়নে নারী-পুরুষের লিঙ্গভেদ ভুলে নারীদের সকল কর্মকাণ্ডে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া জরুরি। বিভিন্ন সমস্যা সমাধান এবং নারীকে তার পূর্ণ প্রতিভার বিকাশ সাধনে সাহায্য করতে হবে। দেশের উন্নয়নে নারীদের ভূমিকা আরও বৃদ্ধি করতে তাদের ক্ষমতায়ন করা জরুরি। ক্ষমতায়নের অর্থ হলো নারীদের স্বাধীনভাবে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়া, তাদের অধিকার রক্ষা করা এবং সমাজে সমান অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া। নারী শিক্ষার ওপর জোর, তাদের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের সুযোগ। নারীদের বিরুদ্ধে হিংসা ও নির্যাতন রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। তবেই সমৃদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ দেশ গঠন সম্ভব।

×