
সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী একটি বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বনভ‚মি। বঙ্গোপসাগরের উত্তরে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার উপক‚লীয় অঞ্চলে সুন্দরবনের প্রধান অংশ অবস্থিত। এর মোট আয়তনের প্রায় ৬২% বাংলাদেশ অংশে। সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, যা ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। এটি পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল। এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, কুমির, বানর, উভচর প্রাণীসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিরল ও বিপন্ন প্রাণীর বসবাস। এই বনে ৩২২টিরও বেশি প্রজাতির মাছ, প্রায় ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবাস রয়েছে। এছাড়া, সুন্দরবনে ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, যা এর পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
সুন্দরবন বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলের জন্য একটি প্রাকৃতিক ঢাল। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস এবং সামুদ্রিক ঝড়ের সময় সুন্দরবনের ঘন বৃক্ষরাজি বাফার জোন হিসেবে কাজ করে। এর ফলে উপক‚লীয় এলাকার জনবসতি, চাষাবাদ ও অবকাঠামো ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। সুন্দরবন যে পরিমাণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করে, তার আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা কঠিন। সিডর, আইলা ও আম্পানের সময় সুন্দরবন না থাকলে উপক‚লীয় অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কয়েক গুণ বেশি হতো। সুন্দরবন থেকে মধু, কাঠ, গোলপাতা, মাছ ও কাঁকড়াসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা হয়, যা লাখো মানুষের জীবিকার উৎস। পর্যটন খাতেও সুন্দরবনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবছর দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
কিন্তু সুন্দরবন আজ নানা রকম হুমকির মুখে পড়েছে, যার বেশিরভাগই মানবসৃষ্ট। সুন্দরবনের কাঠ ও গোলপাতার ব্যাপক চাহিদার কারণে প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সুন্দরবনের বিরল প্রাণীগুলোর শিকার ও পাচার এই বনের জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি। সুন্দরবনের আশপাশে শিল্পকারখানার বর্জ্য ও তেল নিঃসরণ সরাসরি নদীতে পড়ায় জলজ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, এতে মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে। সুন্দরবনের কাছাকাছি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সুন্দরবন সংরক্ষণে বন বিভাগের কার্যক্রমকে আরও কার্যকর ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। ড্রোন ও স্যাটেলাইট মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। অবৈধ কাঠ আহরণ, বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার বন্ধে কঠোর আইনের সঠিকভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সুন্দরবনের আশপাশে শিল্প ও অবকাঠামো নির্মাণে কঠোর পরিবেশগত মূল্যায়ন ও পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে হবে। ইউনেস্কোসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় সুন্দরবনের টেকসই সংরক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব হলো এই অমূল্য সম্পদকে আগামী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা, যাতে সুন্দরবন সবসময় আমাদের রক্ষাকবচ হয়ে থাকতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়