ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১০ মার্চ ২০২৫, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১

দেশে দেশে রমজান সংস্কৃতি

মোহাম্মদ ইমতিয়াজ উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৯:২৬, ৯ মার্চ ২০২৫

দেশে দেশে রমজান সংস্কৃতি

রহমত, মাগফিরাত নাজাতের মহাবার্তা নিয়ে আগমন করে রমজান। এই মাসকে স্বাগত জানাতে বিশ্বজুড়ে মুসলিমগণ প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। রোজা রাখা মুসলমানদের জন্য এই মাসের একটি অপরিহার্য ইবাদত। ইবাদতে মানুষ অর্জন করে আত্মার পরিশুদ্ধিতা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে মাহে রমজান। দেশে দেশে রমজান সংস্কৃতি কেমন? পাঠকের জন্য মুসলিম বিশ্বের দেশভেদে রমজান সংস্কৃতির কিছু আকর্ষণীয় নমুনা তুলে ধরা হলো-

মিসর : প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিসরে উৎসবমুখর পরিবেশে শুরু হয় রমজান মাস। মানুষ যাতে ইবাদত এবং মসজিদে বেশি সময় ব্যয় করতে পারে সেজন্য দেশে রমজান মাসে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কর্মঘন্টা কমিয়ে আনা হয়। মিসরীয়দের অনেক পুরনো সংস্কৃতির একটি হলো রমজান মাসে ঘরে ঘরে বাতি জ্বালানো এবং ফানুস ওড়ানো। কামানের গোলার শব্দে মিসরীয়রা ইফতার শুরু করেন এবং কামানের গোলার শব্দে সেহরি শেষ করেন।

ইরান : শিয়া অধ্যুষিত ইরানে নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে পালিত হয় মাহে রমজান। এই মাসে ইরানের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। অধিকাংশ ইরানিই মাসব্যাপী ইতিকাফ করে থাকেন। তারা সারাদিন অফিস করে মসজিদে রাত যাপন করাকেই ইতিকাফ হিসেবে গন্য করেন। রাতে মসজিদ কর্তৃপক্ষই ইতিকাফকারীদের খাবার সরবরাহ করেন।

আইসল্যান্ড সুইডেন : ইউরোপের একটি প্রজাতান্ত্রিক দ্বীপরাষ্ট্র আইসল্যান্ড। এই দেশে ইফতারের মাত্র দুই ঘণ্টা পরই সেহরি শেষ করতে হয়। অন্যদিকে ইউরোপের তৃতীয় সর্ববৃহৎ দেশ সুইডেনের মুসলমানদের অবস্থাও একই রকম। গ্রীষ্মের রোজা সুইডিসদের জন্য সবচেয়ে কঠিন। ইফতারের মাত্র চার ঘণ্টা পর সেহরি খেতে হয় এই দেশে।

জার্মান যুক্তরাজ্য : ১৯ ঘণ্টা রোজা রাখেন জার্মানির মুসলমানরা। অন্যদিকে জার্মানির চেয়ে পাঁচ মিনিট কম অর্থাৎ প্রায় ১৮ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট রোজা রাখেন যুক্তরাজ্যের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩০ লাখ মুসলিমের বসবাস। এখানকার মসজিদে মসজিদে রোজাদারদের জন্য ইফতারের আয়োজন হয়। ভিন্ন ধর্মের মানুষদের আমন্ত্রণও জানানো হয় এমন অনেক আয়োজনে। দীর্ঘ সিয়াম সাধনার পর রাতে ঘরে ঘরে মসজিদে মসজিদে সালাতুত তারাবিতে মিলিত হতে ভোলেন না যুক্তরাজ্যের মুসলমানরা।

তুরস্ক : তুরস্কে সমগ্র রমজানজুড়ে বড় বড় মসজিদের পাশে বইমেলা এবং কুরআন প্রতিযোগিতা হয়। এটি তুর্কিদের রমজান সংস্কৃতির অংশ। এই মাসে তারা অফিস-আদালত ঠিক রেখেই ইফতারের আগে ঘরে ফেরার চেষ্টা করেন। সেহরির সময় হলেই দেশটির অলিগলিতে বেজে ওঠে ড্রামের শব্দ। মানুষকে সময় মতো জাগিয়ে দেওয়ার জন্য তুর্কি তরুণরা ড্রাম বাজিয়ে সংগীত পরিবেশন করে ডাকাডাকি করেন অনেকটা আমাদের দেশের গজল পার্টির মতো। আবার কামানের গোলার আওয়াজ শোনার মাধ্যমে সেহরি শেষ ইফতার করার সংস্কৃতিও রয়েছে তুরস্কে। দিনের বেলায় রেস্তোরাঁ এবং খাবারের দোকান বন্ধ থাকলেও দুপুরের পর থেকেই চলতে থাকে ইফতারের আয়োজন। সেহরির সময়ও রেস্তোরাঁগুলো খোলা রাখা হয়। দেশটিতে সেহরি ইফতারের সময় অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষরাও মুসলিমদের সঙ্গে সৌহার্দ্য বজায় রেখে যোগ দিতে দেখা যায়। এছাড়া খেজুরের পরিবর্তে জলপাই দিয়ে ইফতারের সময় রোজা ভঙ্গ করা তুর্কিদের অন্যতম একটি সংস্কৃতিও বটে।

ওমান : রমজান মাস উপলক্ষে ওমানে বিভিন্ন দ্রব্যমূল্যে কোম্পানির থাকে বিশেষ ছাড়। ব্যবসায়ীরা যথাযথ ছাড় ক্রেতাদের হাতে বুঝিয়ে দেন সৎভাবে। রমজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ওমানের বিভিন্ন রাস্তার পাশে দেখা যায় সারি সারি তাঁবু। এসব তাঁবু রোজাদারদের ইফতার করানোর জন্য ওখানকার স্থানীয় মানুষ বিশেষভাবে তৈরি করেন। ওমানীয়রা এসময় বেশি পরিমাণে দান-সাদকাহ করেন। দানের সময় শর্ত জুড়ে দেন, যেন তার নাম প্রকাশ না হয়। রসিদে লিখে দিতে হয় একজন দাতা কিংবাআবদুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা)

সৌদি আরব : মক্কা-মদিনার দেশ সৌদি আরবে রমজানের চাঁদ উঠতেই একে অপরের কল্যাণ কামনা করে ক্ষুদে বার্তা বিনিময় শুরু হয়। শহরগুলো নতুন সাজে সজ্জিত হয়। ঘরবাড়ি সংস্কার এবং ধোঁয়ামোছা হয়। আমরা ঈদের আগে যা যা করি সৌদিয়ানরা রমজানের শুরুতে ঠিক তা তা করেন। দান-সাদাকার নীরব প্রতিযোগিতা চলে সৌদি বাসিন্দাদের মাঝে। রোজাদারকে ইফতার করানোর ঐতিহ্যবাহী সৌদি সংস্কৃতি পবিত্র মাসটির সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। রোজাদারকে ইফতার করানোর জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে এবং মসজিদে মসজিদে স্থাপন করা হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষ তাঁবু। বাঙালি, ইন্ডিয়ানসহ ভিনদেশী শ্রমিকরা এসব তাঁবুতে মেহমান হয়ে ইফতার গ্রহণ করেন আর খাদেমের মতো তাদের মাঝে ইফতার বিতরণের কাজটি করেন সৌদিয়ানরা। রোজাদারদের ইফতার করানোর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায় মদিনা মুনাওয়ারায়। বিশেষত মসজিদে নববীর আশপাশে এই দৃশ্য বেশি দেখা যায়। ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন লোভনীয় খাবারের দিকে ছুটে বেড়ায়, মদিনার মানুষেরাও ঠিক সেভাবে ছুটোছুটি করেন রোজাদারকে নিজের দস্তরখানে বসানোর জন্য। সৌদি আরবে সালাতুত তারাবিহ কিয়ামুল লাইল চলে সেহরির পূর্ব পর্যন্ত। সময় মাইক থেকে ভেসে আসা সুমধুর কন্ঠের তিলাওয়াতের সূরের মূর্ছনা আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলে। এখানে দিনের কোলাহল থাকে রাতভর। মাসটিতে বিভিন্ন কোম্পানি, মুদি গ্রোসারি আইটেমে দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়।

সুদান : আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম একটি মুসলিম দেশ সুদানের ইফতারিতে সাধারণত খেজুর, গোশতের হামড়া, লাহমা এবং চালের তৈরিআছিদা গোশত সস দিয়ে তৈরিমুলাহ নামক খাদ্য তারা খেয়ে থাকেন এবং একই সঙ্গেগাওয়া নামক চা জাতীয় পানীয়ও তারা পান করেন। সুদানিরা ইফতারে খুবই ভোজন বিলাসী হয়ে থাকেন। তাই তারাশোরবা নামক স্যুপ, গোশত দিয়ে তৈরিমুহাম্মার নামক খাবার, দুধ ভাত দিয়ে তৈরিরুসবিল হালিব ইফতারিতে রাখেন। পায়েস, ক্ষির, ফিরনি এগুলো তাদের প্রিয় খাবার বটে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত : আরব বিশ্বের ইউরোপ হিসেবে পরিচিত সংযুক্ত আরব আমিরাত। সেখানে রমজানের চাঁদ দেখার সাথে সাথেই একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু হয় রোজা। একইদিনে রমজান শুরু হলেও আলাদা সময়ে সেহরি ইফতার করেন দেশটির শিয়া সুন্নি মুসলিমরা। সুন্নত মেনে খেজুর দিয়ে ইফতার করেন তারা। বরকতের মাসে রোজাদারদের প্রতি আমিরাতবাসীর আতিথেয়তা মুগ্ধ করার মতো। আরব আতিথেয়তার গুণটি এখনো ধরে রাখছেন তারা। রমজান মাস এলেই এখানকার জনগণ পাড়া-মহল্লা বা বড় বড় মসজিদের পাশে তাঁবু-প্যান্ডেল টানিয়ে ইফতার আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি সন্ধ্যার আগে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে রোজাদারদের মাঝে ইফতার বিতরণে ব্যস্ত থাকেন আমিরাতবাসী। অন্যদিকে মাসটির শুরুর সাথে সাথেই বন্ধ করা হয় নাইট ক্লাব এবং মদের বার। মাসে সেখানে প্রকাশ্যে পানাহার ধূমপান Ðণীয় অপরাধ। দেশের সড়কগুলোকে সাজানো হয় ভিন্ন সাজে। এই মাসে দেশটিতে সরকারিভাবে আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতা।

ইরাক : রমজানের চাঁদকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান ইরাকিরা। ইরাকের মুসলমানেরা তোপধ্বনির মাধ্যমে এই মাসকে বরণ করে নেন। এই সংস্কৃতি তারা গ্রহণ করেছেন তুর্কিদের কাছ থেকে। তুর্কিরা উসমানীয় সালতানাতের সময়কালে বাগদাদবাসীকে তোপধ্বনির মাধ্যমে ইফতার সেহরির সময় সম্পর্কে অবগত করাতেন। তোপধ্বনি কালের বিবর্তণে এখনো ইরাকে টিকে আছে জনপ্রিয় রমজানের সংস্কৃতি হিসেবে। তবে এখন আর উসমানীয় আমলের তোপগুলো ব্যবহার করা হয় না। বরং এখন কম্পিউটারাইজড নিয়ন্ত্রিত তোপ ব্যবহার করা হয়। এই মাসে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া ইরাকের আরেকটি ঐতিহ্য। সময় তারা পরস্পরকে ধর্মীয় গ্রন্থাদি উপহার দেন। প্রতিবেশীদের বাড়িতে ইফতার সামগ্রী পাঠান। ইরাকিরা খোলা ছাদে বা বাড়ির সামনে খোলা প্রাঙ্গণে বসে ইফতার করতে পছন্দ করেন। এটা ইরাকের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি। বসরার খেজুর দুধ এবং বিশেষ ধরনের শরবত ইরাকিদের ইফতার সেহরিতে খুবই পছন্দ। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশের ন্যায় এই মাসে ইরাকের মসজিদগুলোও মুসল্লি মুখর হয়ে ওঠে। সব বয়সী মুসল্লির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় মসজিদগুলোতে। অন্যদিকে ইরাকিদের বিয়েগুলো যথাসম্ভব রমজান মাসে সম্পন্ন করা তাদের অন্যতম সংস্কৃতি।

যুক্তরাষ্ট্র : যুক্তরাষ্ট্রে বেশির ভাগ মুসলমান বসবাস করেন নিউইয়র্ক, মিশিগান, ক্যালিফোর্নিয়া, নিউজার্সি, ইলিনয়েস, ইস্তিয়ানো, টেক্সাস, ভার্জিনিয়া মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যগুলোতে। এশিয়ান মুসলিমরা রমজানে তাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে পায়জামা, পাঞ্জাবি কাবুলি সেট কোর্তা পরিধান করেন এবং মহিলা শিশুরা মেহেদি দিয়ে হাত রাঙান। আমেরিকায় ইফতার সামগ্রীর মধ্যে খেজুর, খোরমা, সালাদ, পনির, রুটি, ডিম, গোশত, ইয়োগার্ট, হট বিনস, স্যুপ, চা ইত্যাদি থাকে। আর বাঙালি মুসলমানদের ইফতার তালিকায় অন্য সবকিছুর পাশাপাশি থাকে বিরিয়ানী, খিচুড়ি, শরবত, পিঁয়াজু এবং জিলাপীসহ আরও অনেক কিছু।

মালয়েশিয়া : সাইরেনের শব্দে রমজান মাসের আগমনী বার্তা পৌঁছে যায় সবার কানে কানে।শাহরুন মুবারাকুন বলে অভিবাদন জানিয়ে এবং উপহার বিনিময় করে শুরুতেই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে মজবুত করে নেয় মালয়েশিয়ানরা। দেশে সরকার এবং ব্যবসায়ীরা রামাদান উপলক্ষে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীতে দেয় বিশেষ ছাড়। মালয়েশিয়ানরা অনেকাংশেই ধর্মপ্রাণ। মাসটিতে মালয়েশিয়ার মসজিদগুলো কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকে। তারাবিহসহ অন্যান্য নামাজে নারী শিশুদের উপস্থিতি থাকে লক্ষণীয়। তারাবিহর শেষে বিশেষ শিক্ষামূলক আসর বসে মালয়েশিয়ার মসজিদগুলোতে। সেহরির পর ঘুমানোর অভ্যাস নেই মালয়েশিয়ার মুসলমানদের। স্থানীয় মসজিদে ধর্মীয় আলোচনা শুনে সূর্য উঠলে নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে পড়েন মালয়েশিয়ানরা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

×