ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৯ মার্চ ২০২৫, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১

টেকসই উন্নয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাহয়তা

মো. তানজিমুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৯:০৫, ৮ মার্চ ২০২৫

টেকসই উন্নয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাহয়তা

আজ থেকে ১০ বছর আগে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্বের ৬০টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অগ্রদূত হিসেবে আবির্ভূত হয়। যার অবস্থান ছিল ১৮তম। ১৫ বছর মেয়াদি এই উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে; বিশেষ করে দারিদ্র্যবিমোচন, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে জেন্ডার সমতা, শিশু ও পাঁচ বছর বয়সের নিচে শিশুদের মৃত্যুহার কমানো, মাতৃমৃত্যুহার কমানো, টিকা গ্রহণের পরিধি বাড়ানো ও সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব কমানোসহ নানা পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য। এমডিজির আটটি অভীষ্টের মধ্যে কেবল অভীষ্ট নং ৭ অর্থাৎ ‘পরিবেশগত টেকসই’ বাদে বাকি সব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ১০ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানের এক নিবন্ধে উল্লিখিত হয়েছে এভাবে, ‘বাংলাদেশ এমডিজি (২০০১-১৫) অর্জনে উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যতম বড় সাফল্যগাথা’। আর এই সাফল্যের জন্য বিদেশী দাতা সংস্থাসমূহের যেমন অগ্রণী ভূমিকা ছিল, ঠিক তেমনি এমডিজির শুরুটাই হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকারের হাত ধরে। পরবর্তীতে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরিবর্তিত নির্বাচিত সরকারসহ দেশী বিদেশী উন্নয়ন সংস্থাসমূহ এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এমডিজির লক্ষ্য পূরণে কাজ করে গেছে!  
পরবর্তীতে সময়ের প্রয়োজনে এবং বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মেলাতেই বাংলাদেশ সরকার ‘এসডিজির’ অভীষ্ট ও লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে। পুরো বিশ্বব্যাপী ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’ অর্জনের জন্য পনেরো বছর মেয়াদি (২০১৬-২০৩০) নতুন পদক্ষেপ শুরু হয়। ‘টেকসই উন্নয়ন’ হলো এমন একটি সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র, যার মূল লক্ষ্য গণমানুষের উন্নয়নের পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাকে সহনশীল রেখে অদূর ভবিষ্যতে মানুষের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে রাখা। বিশ্বায়নের এই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) প্রত্যাশিত ফলাফল এমন একটি বসবাস উপযোগী সমাজ, যেখানে গণমানুষের জীবনমান ও নানাবিধ সম্পদের সুষম ব্যবস্থাপনা এবং স্থিতিশীলতাকে ক্ষুণ্ন না করে মানুষের চাহিদা পূরণ করে। টেকসই উন্নয়ন মূলত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে গৃহীত একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা। উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ফলে যেন প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি সাধিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে অর্থাৎ প্রকৃতিকে ঠিক রেখে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পাদন করা হয়। টেকসই উন্নয়ন কেবল পরিবেশ সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়; বরং সামাজিক এবং মানবিক উন্নয়নও এর আওতাভুক্ত।
সংগত কারণেই এসডিজির পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের জন্য তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সচিবদের নেতৃত্বে এসডিজির যে কর্ম-কৌশল শুরু হয়, সেখানে দেশী-বিদেশী উন্নয়ন সহযোগীদের (এনজিও) সমন্বয়ে সারাদেশে অনেক জোড়ালোভাবে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য একটি জোয়ার সৃষ্টি হয়। মূলত অন্যান্য বিদেশী দাতা গোষ্ঠী, বিশেষ করে মার্কিন সরকারের সিংহভাগ অর্থায়নের ফলে এনজিওসমূহ প্রথম সাত বছরে (২০১৬-২২) মোটামুটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করে বিভিন্ন রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে এসডিজি কর্মসূচির ১০ বছর পেরিয়েও গেছে। ইতোমধ্যে  রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ব্যাপক পটপরিবর্তন ঘটলেও এসডিজির পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন একটা প্রভাব চোখে পড়েনি। বিগত দিনের দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসক সরকারের পরিবর্তন ঘটলেও কালক্রমে বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের আওতায় জাতীয়-আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসমূহ বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠীর আর্থিক সহযোগিতায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে চলছিল। আর মাত্র বছর পাঁচেক পরেই এসডিজির মেয়াদকাল শেষ হবে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে উন্নয়ন জগতের নিবেদিতপ্রাণ মানুষগুলো প্রত্যাশায় আছে, ‘এই বুঝি এমডিজির মতো এসডিজির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাপক সফলতা অর্জন করবে!’ কিন্তু সে আশায় যেন গুঁড়ে বালি ঢেলে দিতে ইচ্ছুক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা ট্রাম্প সরকার! আচমকা এক ঝড় যেন সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে চায়!  
পুরো বিশ্বজুড়ে নানা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে ব্যাপক সক্ষমতা রয়েছে, তা নিয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান-তথ্যপ্রযুক্তিসহ সকল ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিকল্প নেই! সারা বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও অস্থিতিশীলতা হ্রাসের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিভিন্ন দপ্তরের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে চলমান এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও পুরো বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী উন্নয়ন সংস্থাসমূহের যেমন ভূমিকা রয়েছে, ঠিক তেমনিই আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসমূহের অবদানকে কখনোই অস্বীকার করা যাবে না। ইউএসএআইডি, ইউকেএআইডি, এইউএসএআইডি, জেএআইসিএ। এর মতো আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসমূহ এদেশে সাধারণত দুই ধরনের কাজ দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে। ‘নিড বেইজড এপ্রোচ (এনবিএ’ ও ‘বেইজড এপ্রোচ (আরবিএ)’! অর্থাৎ চাহিদাভিত্তিক ও অধিকারভিত্তিক এপ্রোচের ভিত্তিতে নানা প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। ফলে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি-অধিকার সচেতনতাসহ অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে, যা ইতোপূর্বে এমডিজির লক্ষ্য পূরণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে এবং চলমান এসডিজির ক্ষেত্রেও সমান ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বর্তমানে এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশটি যেন হঠাৎ করেই হোঁচট খেয়েছে! সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত-বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের তহবিল বাতিল করেছেন। এমনকি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশের ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মসূচিও বাতিল করেছে দেশটি। এটি চরম হতাশার এবং অপ্রত্যাশিতও বটে!
বাংলাদেশে ২৯ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি এবং গণতান্ত্রিক শাসনকে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ শাসন করছে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে খুব জোরেশোরে কাজ করলেও প্রত্যাশিত ফল এখনো তেমন নজরে পড়ছে না। এত কিছুর পরও ইলন মাস্কের ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সির (উঙএও) আর্থিক সহায়তা বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা কেবল বাংলাদেশের অর্থনীতিতেই প্রভাব ফেলেনি; বরং গৃহীত নানামুখী প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসমূহকে যেসব দেশ এতকাল আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের মধ্যে শীর্ষে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণাতেই রাতারাতি গৃহীত প্রকল্পসহ নানাবিধ কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতা সংস্থা তথা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে, সেসব প্রতিষ্ঠানও এখন থেকে আর টেকসই থাকছে না। এমনকি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের নিযুক্ত লোকবল মুহূর্তেই বেকারত্বে নিমজ্জিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে তিলে তিলে গড়া উন্নয়ন জগতের যাবতীয় প্রশিক্ষণসমূহ, নানাবিধ অভিজ্ঞতা, প্রাণপণ চেষ্টা, সবই যেন অর্থহীন হয়ে এলো নিমিষেই! কোনো রকম হিসাব-নিকাশ ছাড়াই বিগত দিনে অপরিণামদর্শী অগণতান্ত্রিক সরকার ঘোষিত ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ খেতাবটি যেন বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বের ইতিহাসে ‘এক আষাঢ়ে গল্প’ হিসেবে স্থান করে দিয়েছে। নানাবিধ কারণে সমগ্র বিশ্ব বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে এদেশের আপামর জনসাধারণের যখন নাভিশ্বাস অবস্থা, ঠিক তখনই মার্কিন সরকারের এমন অপ্রত্যাশিত ঘোষণা যেন ‘মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। নানা দেশী-বিদেশী উন্নয়ন সংস্থার বদৌলতে বিশ্বজুড়ে মর্যাদার দিক থেকে বাংলাদেশ যতদূর এগিয়েছিল বা উন্নয়নের দিকে এগোচ্ছিল, আপাতত তা থমকে গেল!  
‘টেকসই উন্নয়নের’ সারথি হিসেবে যারা এতকাল নিজেদের নিবেদিত করে গেলেন, তারাই আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কমিউনিটিতে, প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায় এতকাল যারা ‘টেকসই উন্নয়ন’ এর কথা বলতেন, তারাই আজ প্রায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন! পরিবারবর্গের জন্য দু’মুঠো খাবার জোগাতে তারা নিজেরাই হিমশিম খাচ্ছেন! একদিকে দ্রব্যমূল্যের চাপে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ সব সময় একটা দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। এই অবস্থার দ্রুত অবসান চায় তারা। এটিও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কেননা, তাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই! তাছাড়া কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর কাছেও কোনোভাবেই দায়বদ্ধ নয়। দায়বদ্ধতা একমাত্র দেশবাসীর কাছে। সেক্ষেত্রে সকল জঞ্জাল সরিয়ে এদেশের জনতা আবারও ঘুরে দাঁড়াবে-এই প্রত্যাশা সকলেরই। একই সঙ্গে একটি শঙ্কা জাগে মনে বারবার, ‘সারাবিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও কী তবে ট্রাম্প সরকার টেকসই উন্নয়ন থমকে দিতে চায়, অচিরেই’? যেমন- এদেশের অপরিণামদর্শী বিগত স্বৈরশাসকের ঘোষিত  অবান্তরমূলক ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ খেতাবটির কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল স্বনামধন্য দাতা গোষ্ঠীগণ! তবু, বুকভরা আশা নিয়ে প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে উন্নয়ন জগতের নিবেদিতপ্রাণসহ এদেশের আপামর জনগণ! শেষ পর্যন্ত নতুন করে ফিরে আসবে তো সেই সুদিন? আবারও গতিশীল হবে তো টেকসই উন্নয়নের পদক্ষেপসমূহ!

লেখক : উন্নয়নকর্মী
[email protected]

×