
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি) বিশ্ববাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তবে এই শিল্পের দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ টেক্সটাইল বর্জ্য। যা এই বিশাল শিল্পের একটি অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। একইসঙ্গে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে টেক্সটাইল রিসাইক্লিং খাত একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যা একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা করছে, অন্যদিকে তৈরি করছে নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প প্রতি বছর আনুমানিক ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টন টেক্সটাইল বর্জ্য উৎপন্ন করে, যা স্থানীয়ভাবে ‘ঝুট’ নামে পরিচিত। এই বর্জ্য মূলত কাপড়ের কাটা অবশিষ্টাংশ, স্ক্র্যাপ, সুতা, বয়ন ও বস্ত্র শিল্পে অন্যান্য উৎপাদিত বর্জ্য। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্র অনুযায়ী, শুধু ২০২২ সালেই ৪ লক্ষাধিক টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এই বর্জ্যরে মধ্যে বিশাল অংশই তুলা-ভিত্তিক, যা পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তুলার বর্জ্য সঠিকভাবে রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশের তুলা আমদানি অন্তত ১৫ শতাংশ কমানো সম্ভব। যার মাধ্যমে প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় হতে পারে বাংলাদেশের। তবে বর্তমানে দেশে উৎপাদিত বর্জ্যরে মাত্র ৫-২৫ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়, যা এ খাতের বিশাল সম্ভাবনাকে প্রতিফলিত করে।
স্থানীয়ভাবে টেক্সটাইল বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। গ্লোবাল ফ্যাশন এজেন্ডা (জিএফএ) এবং ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১.২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পুনর্ব্যবহৃত টেক্সটাইল এবং পোশাক পণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, দেশটিতে তুলার তৈরি পোশাকের বিশাল উৎপাদন ভিত্তি রয়েছে। এই বিশ্লেষণ অনুসারে মোট ছয়টি প্রধান পোশাক উৎপাদনকারী দেশÑভিয়েতনাম, তুরস্ক, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশ এই শিল্প পরবর্তী পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুযোগের মাধ্যমে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের বাজারে প্রবেশ করতে পারে। ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাত আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে আগামীতে।
কেবল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য নয়, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র শিল্প-সৃষ্ট বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়াস বাস্তবায়নের মাধ্যমেও গড়ে উঠতে পারে পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্প। যেখানে বিপুল পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। তিন দশকের বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠা পোশাক খাতে সক্রিয় কারখানা সাড়ে তিন হাজার। এ খাতের কাঁচামাল সরবরাহকারী সুতা-কাপড়ের কারখানা আছে ১ হাজার ২০০টির বেশি। কিন্তু এসব কারখানা ঘিরে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা রিসাইক্লিং শিল্প ইউনিটের সংখ্যা মাত্র গোটা পঞ্চাশেক।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে প্রায় ২০টি পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা উৎপাদন কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেগুলোর সম্মিলিত পুনর্ব্যবহার ক্ষমতা ২৪ লাখ টন (সূত্র: বিজিএমইএ, ২০২৩)। এই কারখানাগুলো টেক্সটাইল বর্জ্যকে নতুনভাবে রূপান্তর করছে, যা বিশ্বব্যাপী টেকসই ফ্যাশনের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিছু বড় উদ্যোগের মধ্যে ‘জবপড়াবৎ’, ‘জবপুপষব জধ’ি কিংবা “ঈুপষড় জবপুপষবফ ঋরনবৎং-এর মতো কিছু উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব পুনর্ব্যবহারযোগ্য টেক্সটাইল উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
টেক্সটাইল বর্জ্য পুনর্ব্যবহার পরিবেশগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। একটি গবেষণা অনুসারে, প্রতি এক টন টেক্সটাইল বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করলে প্রায় ৩.৩৭৬ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন হ্রাস করা সম্ভব। এছাড়া পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতি কেজি তুলা উৎপাদনে ব্যবহৃত ১০,০০০ লিটার পানির অপচয়ও কমানো সম্ভব।
যদিও এই খাতের প্রবৃদ্ধি প্রতিশ্রুতিশীল, তথাপি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। বাংলাদেশের টেক্সটাইল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। প্রায় ২০,০০০ থেকে ২২,০০০ ব্যবসায়ী ঝুট ব্যবসায় নিযুক্ত আছেন, যারা বেশিরভাগই অনানুষ্ঠানিকভাবে টেক্সটাইল বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করেন। এর মাধ্যমে প্রায় ০.৬ মিলিয়ন শ্রমিকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। প্রায় ১০ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে টেক্সটাইল রিসাইক্লিং খাতের ওপর নির্ভরশীল। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তুলা-ভিত্তিক টেক্সটাইল বর্জ্যরে পরিমাণ বর্তমানের তুলনায় চারগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। সম্প্রতি, বিশ্বের বৃহত্তম সুইডিশ খুচরা পোশাক বিক্রেতা এইচএন্ডএম (ঐ্গ) তাদের পোশাক সরবরাহকারীদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাঁচা বা নতুন তুলার চেয়ে তুলার বর্জ্য বেশি ব্যবহার করতে বলেছে। বর্তমানে খুচরা পোশাক বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ডগুলো পরিবেশগত ক্ষতি এড়াতে পোশাকের পুনর্ব্যবহারে উৎসাহী হয়ে উঠছে।
তাছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি নতুন প্রস্তাবিত আইনের কারণে, তুলার বর্জ্য থেকে তৈরি পোশাকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। ২০৩০ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেসব কারখানা তুলার বর্জ্য ব্যবহার করবে না, সেসব কারখানা থেকে পোশাক না কেনার একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই পদক্ষেপটি সার্কুলার ফ্যাশন নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে বার্ষিক ৪০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের তুলার বর্জ্য রপ্তানি করা হয়। স্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারকরা যার তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন। বিজিএমইএ ইতোমধ্যেই সরকারের কাছে তুলার বর্জ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে স্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারকদের জন্য দেশীয় বাজারে এই কাঁচামাল সহজে পাওয়া যায়। তুলার বর্জ্য রপ্তানি না করে পুনর্ব্যবহার করলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই, এই খাতের যথাযথ উন্নয়নের জন্য আরও পুনর্ব্যবহারযোগ্য অবকাঠামো গড়ে তোলা, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের টেক্সটাইল বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য খাত পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভাবনাময় খাত। যদি যথাযথ বিনিয়োগ নীতিমালা, নীতিগত সহায়তা ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, তবে এ খাত বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। টেক্সটাইল বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পের বিকাশ, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে সরকার, উদ্যোক্তা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।
লেখক : বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত