
সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হিসেবে ধরা হয় মানবসৃষ্ট কিছু নেতিবাচক কর্মযজ্ঞ নতুবা প্রাকৃতিক কোনো ঘটনাকে। যদি বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকারন্তরে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী কোনো কোনো মানবসৃষ্ট উৎস, তবে কি অবাক হবেন! বাস্তবে তেমনটাই ঘটছে একবিংশ শতাব্দীর চলতি এই দশকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত বৈরী আবহাওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইট ভাটার উৎপাদন প্রলম্বিত হওয়ার উপর চালানো এক গবেষণায় দেখা যায়, এক দশক আগেও যেখানে ইট ভাটার উৎপাদন সময়কাল ছিল ৫-৬ মাস, ২০১৮ সাল থেকে এই সময়কাল বেড়ে হয় সাড়ে ৬ থেকে ৭ মাস। করোনাকালীন এই সময়কাল হ্রাস পেলেও ২০২১ সাল থেকে পুনরায় ৭ মাস এবং গত মৌসুমে এই সময়কাল প্রায় ৮ মাসে গিয়ে ঠেকেছিল। এতে একদিকে যেমন বাড়তি কাঠ কয়লা পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাসের প্রধান জোগানদাতা কার্বন নিঃসরণের হার ও গড় সময় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে বিগত বছরগুলোর তুলনায় পাহাড় কাটা, বনভূমি ধ্বংস, সমতলের আবাদি জমির টপ সয়েল কাটা প্রভৃতিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এতদিন জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচকতার জন্য কেবল উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে এককভাবে দোষারোপ করা হলেও বর্তমানে দেশের দৈনিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির জন্য পরোক্ষভাবে নিজেদের অতিলোভী স্বার্থপর মানসিকতাকে উপেক্ষা করার অবকাশ নেই। যার ফল আমরা দেখছি দেশের বনভূমির ক্রমহ্রাসমান চিত্র থেকে। দিন দিন বনখেকো লোভীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সমানুপাতে কমছে সবুজ অরণ্য, বিলুপ্ত হচ্ছে সবুজে আচ্ছাদিত বন, পাহাড়, ছায়াশীতল সুনিবিড় পরিবেশ। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা দেশে ইটভাটা বহুমাত্রিক দূষণ ও ধ্বংসের জন্য প্রধানত দায়ী, যা প্রত্যক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। বনভূমি ধ্বংসের পিছনেও বর্তমানে উল্লেখযোগ্য কারণ সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ইটভাটার জ্বালানির জোগানে ব্যবহৃত নির্বিচারে বনের গাছ নিধন। মাত্র বছর পাঁচ আগেও বছরে এক মৌসুম নভেম্বর-এপ্রিল পর্যন্ত ইট ভাটা উৎপাদনে থাকত। এতে অন্তত প্রায় ৭ দফায় ইট পোড়ানো হতো। ভাটার আকারভেদে, মাটি ও জ্বালানির পর্যাপ্ততার ভিত্তিতে এক একটি ভাটায় ১০-৫০ লাখ পর্যন্ত ইট উৎপাদন হয়। যেখানে প্রতি ১০ হাজার ইট পোড়াতে জ্বালানি কাঠ লাগে ১৬০-১৭০ মণ। অথবা প্রতি এক লাখ ইট পোড়াতে কয়লা লাগে ১৫-১৬ টন। এক মৌসুমে প্রতি ইট ভাটা গড়ে ৩০-৪০ হাজার মণ জ্বালানি কাঠ অথবা ৯০০-১০০০ টন কয়লা ও প্রায় ৫ লাখ ঘন ফুট মাটি ইট উৎপাদনে ব্যবহার করে। কিন্তু গত বছর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনিয়মিত ঋতু চক্রে অনাবৃষ্টির সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইট ভাটাগুলোর উৎপাদন জুন মাস পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। এর আগের বছরও যা প্রায় একই সময় পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ফলে দীর্ঘায়িত এই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বায়ুতে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টির জন্য দায়ী সকল গ্যাসের নির্গমনও প্রলম্বিত হচ্ছে, যা প্রকারান্তরে জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পোড়া ইটের বদলে ব্লক ব্যবহারে উৎসাহিত করতে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) বিল-২০১৩’ সংশোধনের জন্য তৎকালীন জাতীয় সংসদে একটি বিল উত্থাপিত হয়। সংসদে সেই বিল পাস হওয়ার পর একই বছরের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯) এর ধারা ৫(৩ক) এ দেওয়া ক্ষমতাবলে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মাটির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমানোর উদ্দেশ্যে সব সরকারি অবকাঠামো নির্মাণের কাজে ইটের বিকল্প হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক। সেই মোতাবেক ইট উৎপাদন ও ভাটার সংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাসের চিত্র দেখার পরিবর্তে বর্তমানে পরিবর্তিত ও অনিয়মিত ঋতু বৈচিত্র্যের সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপরিণামদর্শিভাবে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মযজ্ঞে লিপ্ত অতিলোভী ব্যবসায়ীরা। অথচ অনিয়মিত ঋতু চক্রের এ সুযোগকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যায়। বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে রাতের চেয়ে দিন বড় হওয়ায় সূর্যের প্রখর কিরণকে সোলার প্যানেলের সাহায্যে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সংযোগের মাধ্যমে দেশে বিদ্যুৎ চাহিদার একটি অংশ পূরণের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকারের নতুন সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ৪০% বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের ফলে প্রলম্বিত হচ্ছে ঋতু বৈচিত্র্য এবং এর ফলে অনিয়মিত ঋতু পরিবর্তনে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা কাটিয়ে ওঠা বেশ চ্যালেঞ্জিং। পরিবেশসম্মত প্রযুক্তির বাইরে পুরনো প্রচলিত পরিবেশ বিধ্বংসী পদ্ধতিতে ইট উৎপাদন কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই পরিবেশ উপযোগী টেকসই পদ্ধতিতে ইট উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এতে বনজ সম্পদ ও কৃষিজ জমির ওপর চাপ কমবে।
মানুষ সাধারণত দেখে শিখে, না হয় ঠেকে শিখে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অনিয়মিত ঋতু চক্রের বিরূপ আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে গিয়ে মানবজাতির দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। এখন এর থেকে উত্তরণে তাদেরই সময়োপযোগী কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বৈরী আবহাওয়ার দীর্ঘায়িত সময়কালকে যথোপযুক্তভাবে কাজে লাগাতে হবে। ইটভাটাগুলোর নির্ধারিত একটি অংশ, কলকারখানা ও সুউচ্চ ভবনের ছাদের নির্দিষ্ট অংশ, দেয়াল, ব্রিজ ইত্যাদি স্থানের সম্ভাব্যতা যাচাইের মাধ্যমে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের আওতায় আনতে হবে। এভাবে অনিয়মিত ঋতু চক্রের দীর্ঘ প্রখর রৌদ্রজ্জ্বল সময়কে জলবায়ু পরিবর্তনের আশীর্বাদ রূপে কাজে লাগাতে পারলে দীর্ঘমেয়াদে অভিযোজন প্রক্রিয়া সহজতর হবে, সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের ব্যবহার প্রসার পাবে।