ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৯ মার্চ ২০২৫, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১

শিক্ষায় মানের বিষয়ে গুরুত্ব দিন

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৮:৪৯, ৮ মার্চ ২০২৫

শিক্ষায় মানের বিষয়ে গুরুত্ব দিন

পরিসংখ্যান অনুযায়ী শিক্ষার উন্নয়ন হয়েছে অনেক, কিন্তু গুণগত শিক্ষার মান বাড়েনি। শিক্ষায় বরাদ্দও বৃদ্ধি পেয়েছে। পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। তবে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতভাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠেনি। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়েছে। সেসব স্থানে উচ্চ মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া জরুরি। এ ছাড়া বর্তমান সরকার নতুন শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এ কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অনেক পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষকরা এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। তাই শিক্ষকদের নতুন শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রস্তুত করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। সংখ্যা বা পরিমাণে শিক্ষার উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু মানে উন্নয়ন হয়েছে কি না, এ নিয়ে কিছু কথা রয়েছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় গণহারে জিপিএ-৫ পেয়ে যাচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার খুব কম। তার মানে, শিক্ষার মান তেমন বাড়ছে না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গেলে দেখি, শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল থাকা সত্ত্বেও অনেকে সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না।
আমরা যখন এসএসসি পরীক্ষা দিতাম, তখন বিভিন্ন বই থেকে নোট করে লিখতাম। তাও ১০-এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৬ পেতাম। আর এখন নোট না করে পরীক্ষায় ১০-এ ৮ পায় গণহারে। এসব বিষয় দেখার সময় চলে আসছে। সংখ্যা বেড়েছে যথেষ্ট। এখন সময় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মানের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার দিকে লক্ষ করলেও ব্যাপারটি বোঝা যায়। ভর্তি পরীক্ষায় বিভিন্ন শর্ত ছিল। শর্ত থাকাটাই স্বাভাবিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ‘কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে’র আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের ভর্তির পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর এই ইউনিটে ৯.৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন। অর্থাৎ ৯০.১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই ফেল করেছেন।
বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে বিজ্ঞান অনুষদের ক ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় (২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে) উত্তীর্ণ হয়েছেন ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ)। খ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থী উত্তীর্ণের হার ৯ দশমিক ৮৭ (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ)। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের গ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ)। ঘ ইউনিটে (সমন্বিত বিভাগ) উত্তীর্ণ হয়েছেন ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ)। ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ক ইউনিট থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন ৩ জন, ৯৫ করে। খ ইউনিটে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর ৭৬ দশমিক ৫০। গ ইউনিটে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর ৯৬ দশমিক ৭৫। ঘ ইউনিটে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর যথাক্রমে ৮৩ দশমিক ৯৫, ৮৪ ও ৭৩ দশমিক ১০। জিপিএ-৫ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করছেন না শিক্ষার্থীরা। এটা নিয়ে আলোচনা চলমান। যদিও অনেকে মনে করেন, পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে পাসের হার কমছে। কিন্তু আমাদের মতে, এটা সঠিক তথ্য নয়। কারণ, তা-ই যদি হতো, তাহলে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর ৮৪ বা ৭৬ হতো না। যাঁরা মেধাবী এবং গুণগত মানে উত্তীর্ণ হয়ে যেসব শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছেন, তারা ঠিকই ভর্তি পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
সর্বোচ্চ ফল লাভ করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তারা কেন পাস নম্বর পান না, তা আমাদের বোধগম্য নয়। কম শিক্ষার্থী পাস করায় এবং বিভিন্ন শর্ত থাকায় অনেক বিভাগে আসন খালি রেখে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে হয়, যা অভিভাবকদের অর্থের অপচয়। একইসংখ্যক শিক্ষক বা শ্রেণিকক্ষ নিয়ে যদি বেশি শিক্ষার্থীকে পড়ানো যায়, সেটা তো বেশি যৌক্তিক।
যারা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন, সনদে তাদের ফল অনেক ভালো। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা শুধু মুখস্থবিদ্যায় বেশি গুরুত্ব দেন বলে মনে হচ্ছে। শিক্ষক ও অভিভাবকদের গুরুত্ব দেওয়ার সময় এখনই, যাতে আমাদের ছেলেমেয়েরা সৃজনশীল মেধায় গড়ে উঠতে পারে। প্রাথমিকসহ সব ক্ষেত্রে ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন খুব কম। তাদের বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সব পর্যায়ের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-স্কেল বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন ছাড়া কোনো উন্নয়ন টেকসই হবে না। উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে প্রথমে শিক্ষার মানের বিষয়ে নজর দিতে হবে। যদিও সরকার চেষ্টা করছে; তারপরও কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, সেগুলো বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমরা সবাই যেন সনদমুখী, এ কথা অস্বীকার করতে পারছি না। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শিক্ষায় জ্ঞান অর্জনকে মুখ্য বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে হবে। চাকরি বা সনদ অর্জনের জন্য যে শিক্ষা, তা আসলে প্রকৃত শিক্ষা নয়। এ কারণে সমাজে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে। আমরা মনে করি, সব ক্লাসে, অর্থাৎ প্রথম শ্রেণি থেকে সর্বোচ্চ শ্রেণি পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষার বিষয় থাকা দরকার। বর্তমানে সমাজে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ছিনতাই ও লুটপাট বেড়েই চলেছে। কারণ, ছেলেমেয়েরা নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে না। নৈতিক শিক্ষার জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
মুখস্থনির্ভর শিক্ষার যে ধারা আমাদের দেশে বিপর্যয় ডেকে আনছে, তা এখনো থেমে থাকেনি। বরং আরও বেড়েছে। বিসিএস পরীক্ষা অনেকটা মুখস্থনির্ভর বলে কথা রয়েছে। বর্তমান শিক্ষার্থীরা অনেকেই বিসিএসমুখী। শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেওয়ার সময় বিসিএস গাইড পড়তে দেখা যায়। এ পেশা বেশি লোভনীয়। তাই বিসিএস পরীক্ষায় প্রশ্নপদ্ধতি ও পরীক্ষার ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা জরুরি। কারণ, গতানুগতিক পড়াশোনা করে যাতে কেউ বিসিএস ক্যাডার না হতে পারেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে এ বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাতে মুখস্থনির্ভর বিসিএস পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়।
বিভিন্ন সময়ে নানা সংকটে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি হয়েছে। সেই শিখন ঘাটতি কাঠিয়ে উঠতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন পাঠ্যসূচির সমন্বয় করা। শিক্ষকদের এ বার্তা দেওয়া জরুরি যে, শ্রেণিকক্ষে শিশুদের অংশগ্রহণে সক্ষম করে তুলতে হবে।
সমাজে যাতে নারীরা ভেদাভেদ বা বৈষম্যের শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ্য রেখে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারকে নারী ও শিশু বিষয়ক নানানুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। যেখানে কন্যা-শিশুদের শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে পারব আমরা। নারী ও কন্যা-শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও নৃশংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। যেমনÑ সম্প্রতি মাগুরায় ৮ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু, যাদের বয়স ১৮ বছরের কম। আর শিশুদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ কন্যা-শিশু যাদের পিছনে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্বাধীনভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করা ছাড়াও পরিবার, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন করা সম্ভব। এজন্য কন্যা-শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ বেড়ে ওঠার সব অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বাল্যবিবাহের হার বেড়ে গেছে। তাই এ বিষয়ে সরকারকে কাজ করতে হবেÑ কীভাবে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা যায়। অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। তাদেরও স্কুলে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের বোঝাতে হবে, যাতে তাঁরা অনুপ্রেরণা পান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের পাঠাতে। এ ক্ষেত্রে মানুষ যাতে সাড়া দেয় এবং বিশেষ করে কন্যাশিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, কন্যাশিশুরা বেশি ঝরে পড়েছে পড়াশোনা থেকে। মূলত ভালো গ্রেড অর্জনকে গুরুত্ব না দিয়ে শ্রেণিশিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষক, অভিভাবক ও সরকারকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

×